হার না মানা মনিকা তাঁর জীবনযুদ্ধে জয়ী

মনিকা হালদার এখন ব্র্যাক ব্যাংকের স্বরূপকাঠি শাখায় অফিসার পদে কাজ করছেন।

পিরোজপুর স্বরূপকাঠি থানার দৈহারি গ্রামের উচ্ছল কিশোরী মনিকা হালদার। বাবা পল্লিগীতি করেন। ছোটবেলা থেকে বাবার গান শুনে বড় হলেও মনিকাকে বরাবরই যেন রবীন্দ্র সংগীত টানতো। ১৯৯৭ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে বিভাগীয় রবীন্দ্রসংগীতে সেরা প্রতিযোগী হিসেবে নির্বাচিত হন মনিকা। ২০০১ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন মনিকা। সকল লিখিত পরীক্ষা শেষ, মন ফুরফুরে। ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল, খোশ মেজাজ নিয়ে ঘুমোতে যান মনিকা। ইচ্ছে সকালে উঠে ব্যবহারিকের প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষার হলে যাবেন। কিন্তু বিধির লিখন! সেই রাতেই দুর্বৃত্তের ছোড়া অ্যাসিডে মনিকার হাত, মুখ, বুক ঝলসে যায়। মনিকা পরীক্ষার হলে পৌঁছানোর আগেই পৌঁছান হাসপাতালে। সেদিনের সেই অতটুকুন মেয়ে কোথা থেকে এত সাহস পেলো কে জানে! অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণা উপেক্ষা করে ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশ নিলেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে আনা হয় ঢাকায়। চিকিৎসা শুরু হয়।

এসএসসিতে জিপিএ-৩.১৩ পান মনিকা। কেবল এসএসসি নয়, বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা ইডেন কলেজ থেকে স্নাতকোত্তরও শেষ করেন তিনি। ২০০৩ সালে রবীন্দ্রসংগীতে তালিম নেওয়ার জন্য ছায়ানটেও ভর্তি হন। জীবনের সব পরীক্ষায় পাস করে জীবনকে দেখিয়ে দিয়েছেন মনিকা হালদার।

মনিকার চিকিৎসার একদম শুরু থেকেই তাঁর পাশে থেকেছে প্রথম আলো ট্রাস্টের 'অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল'। যেই মেয়েটি জীবনের শুরুতেই দুর্ঘটনার স্বীকার হয়েও যুদ্ধ জয়ের জন্য তৈরি, তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য কার! মনিকার পড়াশোনা পরবর্তীতে চাকরি প্রাপ্তিতেও 'অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল' তাঁর পাশে ছিল। তাঁর চিকিৎসায় সাহায্য করেছে অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন। চাকরিপ্রাপ্তিতে ব্র্যাক ব্যাংক সহায়তা করেছে। সার্বক্ষণিকভাবে পাশে থেকে মানসিকভাবে সাহস জুগিয়েছেন জীবনসঙ্গী উত্তম কুমার কর্মকার৷

মনিকা হালদার ব্র্যাক ব্যাংকের স্বরূপকাঠি শাখায় অফিসার পদে কাজ করছেন। দুই সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে এখন সুখের সংসার তাঁর। সেদিনের সেই অতটুকুন কিশোরী হার মানেনি। জীবনের সকল পরীক্ষায় পাস করার জেদ নিয়ে যেই মেয়েটি কষ্ট করেছিল, সেই মেয়েটি আজ সত্যিই জয়ী। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। শুধু যে নিজেই সাহস করে আজ জীবনের মোড় ঘুরিয়েছেন তাই নয়। সাহস হয়েছেন শত শত মেয়েদের। সকলকে শিখিয়েছেন যে জীবনে হার মানতে নেই। হাল ছাড়তে নেই।

উল্লেখ্য, প্রথম আলো ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল গঠিত হয় ২০০০ সালের ১৯ এপ্রিল। 'আর একটি মুখও যেন অ্যাসিডে ঝলসে না যায়' অঙ্গীকার নিয়ে প্রথম আলো অ্যাসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন, ফিচার, সম্পাদকীয় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে থাকে। যেখানে অ্যাসিড-সন্ত্রাস, সেখানেই প্রতিরোধ। অ্যাসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি ও জনমত গড়ে তোলার পাশাপাশি অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের সহায়তা দিচ্ছে 'অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল'। এই তহবিলের মাধ্যমে ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪৫৬ জন অ্যাসিডদগ্ধ নারীকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ জনকে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ, ১০০ জনকে চিকিৎসা সহায়তা, ১২ জনকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ এবং সৌন্দর্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ২৩ জনকে। এ ছাড়া শিক্ষা সহায়তা ১৭ জনকে, মাসিক ভাতা পাচ্ছেন ৪ জন, আইনি সহায়তা দেওয়া হয়েছে ৪ জনকে।

অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৯ বছরের মধ্যে ২০০২ সালে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা ছিল সবচেয়ে বেশি—৪৯৪ টি। কঠোর আইনি ব্যবস্থা, গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার ও বহুমুখী কার্যক্রমের ফলে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা কমে ২০২১ সালে ৫ এর ঘরে এসে পৌঁছায়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, এখনও বিচ্ছিন্নভাবে এই সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। যারা এই সহিংসতা ঘটাচ্ছে, তারা কোথায়, কিভাবে অ্যাসিড সংগ্রহ করছে তা যেমন খুঁজে বের করতে হবে তেমনি অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই, বাংলাদেশে অ্যাসিড সহিংসতার সংখ্যা কেবল ৫ নয় নেমে আসুক শূন্যের ঘরে।

লেখক: সমন্বয়ক, প্রথম আলো ট্রাষ্ট।