বাক্প্রতিবন্ধকতা জয় করে সজীব এখন দক্ষ কর্মী
ঢাকার নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের বসবাস কামরাঙ্গীরচর এলাকায়। বুড়িগঙ্গা নদীর কোলঘেঁষা এই কামরাঙ্গীরচরের হুজুরপাড়ার অলগলি পেরিয়ে পৌঁছালাম শপিং ব্যাগ তৈরির ছোট্ট এক কারখানায়। সেখানে মেশিনের ভেতর থেকে থরে থরে বেরিয়ে আসছে রঙিন শপিং টিস্যু ব্যাগ। এ কারখানার চারটি মেশিনের মধ্যে একটি নিয়ন্ত্রণ করছেন মো. সজীব নামের এক তরুণ। সজীব তখন কাজে মগ্ন। হাতের ইশারায় পাশে থাকা সহকারীকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। মূলত সজীব ইশারা ভাষাতেই কথা বলেন। কারণ, ছোটবেলা থেকেই তিনি শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী। তবে তাঁর কাজের দক্ষতা দেখে বোঝার উপায় নেই, সজীবের কোনো বাক্প্রতিবন্ধকতা আছে।
অদম্য সজীবের সাফল্যের গল্প শুনতেই মক্কা প্লাস্টিক অ্যান্ড রাবার ইন্ডাস্ট্রিজে গিয়েছিলাম। ২০ বছর বয়সী সজীব এ কারখানায় মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন। বছর চারেক আগে সাড়ে সাত হাজার টাকায় এ কারখানায় মেশিন সহকারীর কাজ নিয়েছিলেন সজীব। চাকরি শুরুর এক বছরের মধ্যেই সজীব পদোন্নতি পেয়েছেন। তাঁর নিখুঁত কাজে কারখানার সবাই মুগ্ধ।
ফেলে আসা শৈশবে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে সজীবকে। তিন বছর বয়সে খিঁচুনিসহ জ্বর হয় সজীবের। ১১ দিনের ওই জ্বরে শ্রবণ ও বাক্–শক্তি হারান তিনি। এরপর ছেলেকে নিয়ে বিপাকে পড়েন সজীবের মা রেশমা বেগম ও তাঁর বাবা রিকশাচালক আবদুল কাদের। পড়াশোনার জন্য ঢাকার মহাখালীতে প্রতিবন্ধী শিশুদের বিশেষায়িত একটি স্কুলে সজীবকে ভর্তির জন্য চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছিলেন। কামরাঙ্গীরচর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার নিয়মিত পাড়ি দিয়ে মহাখালী যাতায়াত তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই ছেলেকে প্রথমে স্থানীয় এক মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছিলেন তাঁর মা-বাবা। তবে কথা বলতে না পারায়, সেখানকার পড়াশোনার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না সজীব। ২০১২ সালে এক প্রতিবেশী সজীবের পরিবারকে সীড-সামিট কমিউনিটি থেরাপি সেন্টারের খোঁজ দেন।
নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ও সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিদের জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুর ও কামরাঙ্গীরচরে দুটি বিশেষায়িত সেন্টার পরিচালনা করে এনজিও সীড। শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী দিলারা সাত্তার মিতু ২০০৩ সালে এই সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে প্রি–স্কুলের জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি শিশুদের থেরাপি, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও জীবনমুখী বিভিন্ন শিক্ষা দেওয়া হয়। ১৫ বছর ধরে (২০০৯ সাল) সামিট গ্রুপের সহায়তায় কামরাঙ্গীরচরে অবস্থিত এ সেন্টার সেবা দিয়ে আসছে। ২০১২ সালে সজীব ওই সেন্টারে ভর্তি হন। সজীবের মা রেশমা বেগম বলেন, ওই সেন্টারে ভর্তির পর থেকে সজীব পড়াশোনায় মনোযোগী হন। সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করতে শেখেন।
সীড-সামিট কমিউনিটি থেরাপি সেন্টারে তিন বছর পড়াশোনা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর সজীব ভর্তি হন কামরাঙ্গীরচর মডেল স্কুলে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। তবে এর পর থেকে সহপাঠীদের সঙ্গে পড়াশোনায় তাল মেলাতে পারছিলেন না সজীব। একপর্যায়ে স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। মূল ধারার স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ার পর সজীবকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল তাঁর পরিবার। ওই সময় সন্তানের জন্য আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বিভিন্ন তীর্যক মন্তব্য শুনতে হয়েছে রেশমা বেগমকে। তবে তিনি মনোবল হারাননি। কারণ, তাঁর আশা ছিল, সজীব বাক্–প্রতিবন্ধকতার কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে না পারলেও সে কারও বোঝা হয়ে থাকবে না। তাই ২০১৯ সালে ব্যাগ তৈরির কারখানায় সজীব চাকরি শুরু করেন।
ব্যতিক্রমী এই কমিউনিটি থেরাপি সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা দিলারা সাত্তার মিতু বলেন, ‘একজন প্রফেশনাল শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী হিসেবে আমি আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী শিশুদের মূলধারায় নিয়ে আসার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমি সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানের প্রতি কৃতজ্ঞ। কারণ, তাঁরা এক যুগের বেশি সময় ধরে আমাদের পাশে আছেন।’
মক্কা প্লাস্টিক অ্যান্ড রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার মিলন বিশ্বাস বলেন, ‘সজীব খুবই ভালো কাজ করে। এই কারখানার সেরা পাঁচ কর্মীর একজন হলো সজীব। সে কথা বলতে না পারলেও কাজে কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই । প্রথম যখন সজীব এখানে আসে, তখন কথা বোঝাতে একটু সমস্যা হতো। কিন্তু আস্তে আস্তে আমাদের অভ্যাস হয়ে যায়। সজীবের সুবাদেই এখন আরও দুজন শ্রবণপ্রতিবন্ধী আমাদের কারখানায় কাজ করে।’
এদিকে সজীবকে নিয়ে অনেক আগে থেকেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন সজীবের মা রেশমা বেগম। তিনি সব সময় চাইতেন, তাঁর ছেলে যেন কারও বোঝা না হয়। মায়ের সেই আশা পূরণ হয়েছে। কারণ, সজীব এখন স্বনির্ভর। এখন প্রতি মাসে মায়ের হাতে ১০ হাজার টাকা তুলে দেন তিনি।
সীড প্রসঙ্গে সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান বলেন, ‘সীড কমিউনিটি থেরাপি সেন্টার প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করছে, যারা স্নায়ু প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সমাজের অতিদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে। সকল শিশুই সুন্দর পৃথিবীর দাবিদার। আমাদের কর্তব্য তাদের সেই পৃথিবী দেওয়া। সীডকে ধন্যবাদ। আমার মতে, শিশুদের জন্য বিনিয়োগ হলো সবচেয়ে জরুরি বিনিয়োগ।’
উল্লেখ্য, সজীব কারখানায় চাকরি করলেও এখনো তাঁকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের আওতায় রেখেছে সীড।