শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে আলোর পাঠশালা
প্রথম আলো ট্রাস্ট ২৩ মে এক যুগপূর্তি করল। ১২ বছরে প্রথম আলো ট্রাস্ট সামাজিক উন্নয়নমূলক নানাধর্মী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। সার্বিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিষয়গুলো আগামী সাত দিন থাকবে সাতটি ধারাবাহিক পর্ব। আজ থাকছে আলোর পাঠশালা নিয়ে প্রথম পর্ব।
সুফিয়া খাতুন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বাবুডাইং আলোর পাঠশালার পঞ্চম শ্রেণিপুড়য়া। ঈদ উপহার পেয়ে সুফিয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে জানায়, ‘গতবার ঈদে কোনো বাড়িতেই পোলাও হয়নি। করোনার ল্যাগা অভাব ছিল। এবার ঈদে পোলাও হবে। খুব মজা হবে। আমার খুব আনন্দ লাগছে।’
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বাবুডাইং গ্রামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি পাঠশালার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি সুরেন কোল টুডু বলেন, ‘গাঁয়ের লোকের পোলাও খাওয়ার অভ্যাস নাই। খ্যায়া থাকলে দু-তিন বাড়িতে খ্যায়া থাকতে পারে। এবার সকলেই খাইবে। খুব আনন্দ হোইবে এবার। তুমরা গত বচ্ছরও করোনাতে দুবার খাবার দিয়াছিলা, হামরা ভুলিনি।’
স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিপড়ুয়া জীবন টুডু। জীবনের বাবা ভারতে গিয়ে ছয় বছর হলো কারাগারে। সুরেন কোল টুডু বলেন, ‘অরা তো জীবনে পোলাও খায়নি। এবার খাইবে। খুব ভালো হইল।’ যেখানে সুফিয়াদের এই আনন্দ, সেখানে কক্সবাজারের টেকনাফের দমদমিয়া আলোর পাঠশালার গল্পটা একটু অন্য রকম। ৮ মে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে ও সামিট গ্রুপের সহযোগিতায় বাবুডাইং আলোর পাঠশালার ৩১৮ জন শিক্ষার্থীর হাতে ঈদ উপহার তুলে দেওয়া হয়।
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার দমদমিয়া আলোর পাঠশালার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত পারভিন আক্তার। প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৫ এপ্রিল পারভিন মারা যায়। ১২ মে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে ও সামিট গ্রুপের সহযোগিতায় বিদ্যালয়ের ১৯৯ জন শিক্ষার্থীর হাতে ঈদ উপহার তুলে দেওয়া হয়। উপহারের সেই তালিকায় পারভিন আক্তারের নামও ছিল। পারভিনের হয়ে তার বাবা এনায়েত উল্লাহ আসেন ঈদ উপহার নিতে। মেয়ের নামে বরাদ্দ উপহার হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
আবার দমদমিয়া গ্রামের নবী হোসেন, পেশায় একজন জেলে। চার বছর ধরে ইয়াবা ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছে বিজিবি। আলোর পাঠশালা থেকে তাঁর মেয়ে ঈদ উপহারসামগ্রী পাবে, এ খবরে তিনিও এসেছিলেন। নবী হোসেন বলেন, ‘প্রায় সময় না খেয়ে দিন যাচ্ছে। ঈদের আগে হঠাৎ করে উপহার পাব, সেটা কোনোভাবেই চিন্তা করিনি। ত্রাণ পেয়ে আমার পরানে পানি এসেছে এবং প্রাণও রক্ষা পেয়েছে।’
এমন অনেক আনন্দ আর কষ্টের গল্প লুকিয়ে আছে প্রথম আলো ট্রাস্টের আলোর পাঠশালার নানা কাজে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে এখনো শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি, তেমন এলাকায় শিক্ষার আলো পৌঁছে দিচ্ছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। সামিট গ্রুপের সহায়তায় প্রথম আলো ট্রাস্ট বর্তমানে কুড়িগ্রামে একটি, রাজশাহীতে দুটি, ভোলায় একটি, নওগাঁয় একটি এবং কক্সবাজারে একটি করে মোট ছয়টি স্কুল পরিচালনা করছে। ছয়টি স্কুলে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৩০০ জন। পড়াশোনার পাশাপাশি এ স্কুলগুলোতে উদ্যাপিত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, সরস্বতী পূজা, বার্ষিক খেলাধুলা। বিভিন্ন উৎসবে তখন গ্রামের সব বয়সের নারী-পুরুষ ও শিশু বিদ্যালয়ের মাঠে জড়ো হয়। বিদ্যালয়গুলোকে ঘিরে গ্রামের মানুষ এক হয়, যা সামাজিক সম্প্রীতি বাড়ায় এবং সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া করোনার এ বৈশ্বিক বিপর্যয়ের সময় ২০২০ সালে ছয়টি স্কুলের সব শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারকে দুই দফা খাদ্যসহায়তা প্রদান করেছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। এ বছরেও একইভাবে স্কুলগুলোর পাশে আছে ট্রাস্ট।
যেসব এলাকায় শিক্ষার আলো পৌঁছাত না একসময়, সেখানের ছেলেমেয়েরা এখন পড়াশোনা করছে। করছে ভালো ফলাফল। বাবুডাইং আদিবাসী আলোর পাঠশালা থেকে ২০১১ হতে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ১৪৯ জন পিইসি এবং ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ২৬ জন জেএসসি পরীক্ষায় এবং ২০২০ সালে ছয়জন এসএসসি পাস করেছে। পিইসি, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় কেউ জিপিএ-৫ না পেলেও প্রতিবছরই শতভাগ পাস করে আসছে। পিইসি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ৪.৭৪ ফলাফল এসেছে। গুড়িহারী কামদেবপুর আলোর পাঠশালার শিক্ষার্থীদের ফলাফলও বেশ ভালো। শতভাগ পাসের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ৮৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩ জন জিপিএ–৫ এবং ২৬ জন জিপিএ–৪ পেয়েছে।
রাজশাহী আলোর পাঠশালার গল্প
প্রথম আলো ট্রাস্ট পরিচালিত ছয়টি আলোর পাঠশালার মধ্যে রাজশাহী আলোর পাঠশালার গল্পটি আবার একটু আলাদা। স্কুলটি যেই চরখিদিরপুর গ্রাম থেকে তার যাত্রা শুরু করেছিল, সেই গ্রামটি ছিল শতভাগ বাল্যবিবাহের গ্রাম। দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণির মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। এ গ্রামের লোকজন জানতই না যে পঞ্চম শ্রেণির পর পড়াশোনা করা যায়। সেই গ্রামের মেয়েরা আজ রাজশাহীর শাহ মখদুম কলেজ রাজশাহীতে। যদিও ২০২০ সালের ভয়াবহ নদীভাঙনে চরখিদিরপুর গ্রামটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। চরের লোকজন চলে এসেছে রাজশাহী শহরে। শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে স্কুলটিকেও নিয়ে আসা হয়েছে রাজশাহী শহরের তালাইমারী এলাকায়।
রাজশাহী আলোর পাঠশালাতেও শিক্ষার্থীদের পাসের হার শতভাগ। আলোর পাঠশালা রাজশাহী থেকে ২০১৮ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ১৭ জন এসএসসি পাস করেছে।
নদীভাঙনের ফলে চর খিদিরপুর থেকে আলোর পাঠশালা সরে এলেও প্রথম আলো চর আলোর পাঠশালার শিক্ষকেরা প্রতিদিন নদী পার হয়ে প্রায় দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার চরের পথ হেঁটে পৌঁছান প্রথম আলো চর আলোর পাঠশালায়।
কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের শেষ সীমানায় দুধ কুমার নদের পূর্ব পারে, ব্রহ্মপুত্র নদের মোহনায় দুর্গম বিস্তীর্ণ এলাকাটির নাম প্রথম আলো চর। বিশাল এ চরে কোনো বিদ্যালয় না থাকায় এখানকার শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে দূরে ছিল। প্রথম আলো এ চরে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম আলো চর আলোর পাঠশালা। ধীরে ধীরে শিশুরা বিদ্যালয়মুখী হতে শুরু করে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এত কষ্ট করে যেসব শিক্ষার্থীর কাছে আলোর বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন শিক্ষকেরা, তাঁদের সেই কষ্ট বৃথা যায়নি। ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ১৮৩ জন শিক্ষার্থী পিইসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জেএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৩ জন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর প্রথম আলো ট্রাস্ট থেকে ভোলার মদনপুর চরে প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করা হয়েছিল। ২০১৪ সালে এটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তর হয়। পরে স্থানীয়দের অনুরোধে এখানে নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় চালু করা হয়। মদনপুর আলোর পাঠশালা ভোলার দৌলতখানের মেঘনা নদীর মাঝের চরে অবস্থিত। এখানে তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে লেখাপড়া করার মতো কোনো বিদ্যালয় ছিল না। ফলে ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে পশুপালন, কৃষিকাজ, মাছ ধরার কাজে জড়িয়ে পড়ে। আর্থিক সংকটের কারণে অভিভাবকেরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের অন্য কোথাও নিয়ে লেখাপড়া করাতেন না। এ অবস্থায় এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সহযোগিতায় ২০১৩ সালে মদনপুর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ২০১৫ সালে মদনপুর আলোর পাঠশালা নামে প্রথম আলো ট্রাস্ট স্কুলটি পরিচালনা করে। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ৪৮ জন শিক্ষার্থী এই স্কুল থেকে জেএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
আলোর পাঠশালা তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয় দমদমিয়া আলোর পাঠশালা। ২০২০ সালে এ স্কুলের দায়িত্ব নেয় প্রথম আলো ট্রাস্ট। অটো-পাসের সুবাদে স্কুলের ২১ জন শিক্ষার্থীই পিইসি পাস করে।
২০২০ সাল থেকে করোনার প্রকোপে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কিন্তু থেমে নেই আমাদের আলোর পাঠশালার শিক্ষকেরা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এসব শিক্ষার্থীর অনলাইনে ক্লাস করার প্রয়োজনীয় সুবিধা নেই। স্মার্ট ডিভাইসে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া আলোর পাঠশালার শিক্ষার্থীদের জন্য বিলাসিতা। তাই শিক্ষকেরা নিজেরাই চলে যান শিক্ষার্থীদের বাসায়। করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আলোর পাঠশালার শিক্ষকেরা রুটিন তৈরি করে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে আসছেন। এতে করে একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকের যোগাযোগ বাড়ছে, আবার শিক্ষার্থীরা তাদের বাড়িতে বসে বিষয়ভিত্তিক সমস্যার সমাধান করতে পারছে। পড়াশোনার মধ্যে থাকার কারণে এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়ার যে আশঙ্কা ছিল, তা অনেকটাই দূর করা গেছে। আর শিক্ষার্থীরাও নিয়মিত চর্চার মধ্যে থাকতে পারছে।
এভাবেই আলোর পাঠশালা আলোর বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশজুড়ে। প্রথম আলো ট্রাস্ট চায় আলোর পাঠশালার সংখ্যা ৬ থেকে ৬০ হোক। ৬০ থেকে ৬০০ হোক। আলোর মশাল হাতে আলোর পাঠশালার শিক্ষার্থীরা শুধু দেশ নয়, বিদেশের পথে–প্রান্তরে ঘুরে বেড়াক। বিজয় নিশান উড়িয়ে বাংলার মুখ আরও আলোকিত করুক।