মাদক গ্রহণ করলে পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হয়

প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলনের উদ্যোগে ২৩ নভেম্বর বিকেল চারটায় পরামর্শ সহায়তা-৪৪-এর আসরটি অনুষ্ঠিত হয় ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে। এ আয়োজনে মাদকাসক্ত রোগীরা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। মনোরোগ চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা মাদকাসক্তি নিরাময়ের জন্য তাঁদেরবিভিন্ন পরামর্শ দেন। পরামর্শ সহায়তা অনুষ্ঠানের আলোচিত বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো
তাজুল ইসলাম উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, মাদকাসক্ত আর দশটা রোগের মতো একটা রোগ। তবে এটা মন ও ব্রেনের রোগ। সঠিক নিয়মে চিকিৎসা করলে এ রোগ ভালো হয়। মাদকাসক্ত রোগটিকে ডায়াবেটিসের সঙ্গে তুলনা করা হয়। নিয়ম মেনে চললে ডায়াবেটিস রোগ কোনো সমস্যা করতে পারে না। মাদকাসক্তদের ক্ষেত্রেও নিয়ম মেনে চলতে হয়। নিয়ম মেনে চললে মাদক থেকে অবশ্যই যে কেউ মুক্ত থাকতে পারে। মাদক ছাড়ার জন্য দৃঢ়ভাবে ইচ্ছা পোষণ করতে হবে। নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হবে। অনেকে মনে করেন চিকিৎসার পর দায়িত্ব শেষ। রোগী ভালো হয়েছে। মাদকের ক্ষেত্রে এ ধারণা মোটেই সঠিক নয়। চিকিৎসাকেন্দ্র মাদকমুক্ত থাকার জন্য রোগীকে প্রস্তুত করে দেয়। ভবিষ্যতে মাদকমুক্ত থাকার মোটেই নিশ্চয়তা দিতে পারে না। চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে বের হওয়ার পর এক-দুই বছর নিয়ম-নীতি মানা এবং ডাক্তারের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ছাড়া ভালো থাকতে পারবেন না।
সমস্যা: আমার ছেলের বয়স ২৩ বছর। প্রায় পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে ফেনসিডিল খায়। কীভাবে এ নেশা থেকে মুক্ত থাকতে পারবে?
সমাধান: আপনার ছেলে দীর্ঘদিন ফেনসিডিল খাচ্ছে। সে এখন ফেনসিডিলের ওপর নির্ভরশীল। বিষয়টিকে গোপন রাখার দরকার নেই। খোলামেলা সবার সঙ্গে কথা বলুন। সে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তার সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে। পরিবারের দায়িত্বশীল সবাইকে তার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। সবভাবে বোঝানোর পর যদি ভালো না হতে পারে তাহলে অবশ্যই কোনো চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। সে একা ফেনসিডিল ছাড়তে পারবে না। কেউ দীর্ঘদিন কোনো মাদক নিতে থাকলে নিজে নিজে ছাড়তে সমস্যা হয়। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব কোনো বিশেষজ্ঞের কাছে আনতে হবে। তার শরীরের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক ওষুধ দেবেন। শারীরিক-মানসিক অবস্থা বেশি খারাপ হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেবেন। চিকিৎসকের নির্দেশমতো চললে দ্রুত ভালো হবে। সরকারি হাসপাতালে যেতে পারেন। জাতীয় মানসিক হাসপাতালে আসলে আমরা তার চিকিৎসা করতে পারব। খরচও বেশি হবে না। মাত্র ১০ টাকায় টিকিট করে দেখাতে পরেন।
সমস্যা: আমার ছেলে প্রায় ১০ বছর ধরে ফেনসিডিল খায়। ফেনসিডিল খেলে কী কী সমস্যা হতে পারে?
সমাধান: ফেনসিডিল খেলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। এ সমস্যাগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন: এক. শারীরিক সমস্যা, দুই. মানসিক সমস্যা, তিন. সামাজিক সমস্যা ও চার. মূল্যবোধের সমস্যা। ফেনসিডিলের মধ্যে এক ধরনের কেমিক্যাল এজেন্ট থাকে। এটা শরীরকে অসাড় করে দেয়। স্নায়ুতন্ত্রের ওপর চাপ তৈরি করে। রক্তের চাপকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিশোরদের ক্ষেত্রে ফেনসিডিল চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাদের প্রজননক্ষমতার বিকাশকে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত করে। যৌন দুর্বলতা দেখা দেয়। শরীরের বিভিন্ন হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে। নারীদের সন্তান উৎপাদনক্ষমতা কমে যায়। গর্ভবতী মায়েদের বাচ্চার ক্ষতি হয়। নারীদের অন্যান্য স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে দেয়। ফেনসিডিলে কিডনির ক্ষতি হয়। যারা ফেনসিডিল গ্রহণ করে তাদের মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশা তৈরি হয়। সন্দেহপ্রবণতা বাড়ে। সন্দেহের জন্য নারী-পুরুষের মধ্যে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। চিন্তাশক্তি নষ্ট হয়। মাদক গ্রহণ করলে পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হয়। ঘুমের সমস্যা হয়। খাবারের প্রতি রুচি নষ্ট হয়। দিন দিন শরীর দুর্বল হতে থাকে। এদের কোনো নীতি বা নৈতিকতা থাকে না। সামাজিক মূল্যবোধ থাকে না। মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসা নষ্ট হয়। ফলে কোনো অবস্থাতে ফেনসিডিলসহ কোনো প্রকার মাদক গ্রহণ করা যাবে না।
সমস্যা: আমার ভাইয়ের বয়স ৩২ বছর। সীমান্ত এলাকায় থাকে। সব ধরনের মাদক নেয়। তাকে দুই বছর আটকে রাখা হয়েছিল। তার জন্য কী করতে পারি?
সমাধান: সীমান্ত জেলায় ও এর আশপাশের এলাকায় মাদকের ছড়াছড়ি। প্রায় সব ধরনের মাদক সেখানে পাওয়া যায়। কেউ একবার মাদকের ওপর নির্ভরশীল হলে নিজ থেকে ভালো হওয়া কঠিন। তাকে কোনো নিরাময়কেন্দ্রে আনতে হয়। ঘরে বন্দী করে রাখা ঠিক হয়নি। কাউকে বন্দী করে রাখা একেবারেই কোনো সমাধান না। তাকে যখন কোনোভাবেই মাদক থেকে ফেরানো যাচ্ছে না, তখন ভালো হতো কোনো নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি করালে। ঘরে থাকার জন্য তার শরীর ও মনের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। তার মনমানসিকতা বিষণ্ন থাকবে। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা কঠিন হবে। আর দেরি না করে ভালো কোনো চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। তার স্বাস্থ্যের বিভিন্ন পরীক্ষা করতে হবে। ডাক্তার পরামর্শ দিলে তাকে নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি করতে হবে। তার পরিপূর্ণ চিকিৎসা করতে হবে। অনেকে চিকিৎসা শেষ না করে মাঝপথে চলে যায়। যে কারণে আবার মাদকাসক্ত হয়। চিকিৎসার পর ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে সে মাদকমুক্ত হবে। সে যেহেতু দুই বছর ঘরে বন্দী আছে। এখন তার মানসিক সমস্যা আছে বলে মনে হয়। তাকে কোনো মানসিক ডাক্তারকেও দেখাতে হবে।
সমস্যা: আমার ছেলে ১২ বছর ধরে গাঁজা খায়। এখন অনেকটা সেরে উঠেছে। কিন্তু শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে কিছু মনে রাখতে পারছে না। তা ছাড়া কোনো বিষয়ের প্রতি মনোযোগ নেই।
সমাধান: গাঁজার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য আছে। গাঁজার ধোঁয়া প্রথমে ফুসফুসে যায়। এরপর রক্ত ও মাথার মধ্য দিয়ে কোষে ঢোকে। গাঁজার মধ্যে এমন একটি বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্য আছে, এটা একবার স্নায়ুকোষের মধ্যে ঢুকলে প্রায় এক বছর থাকে। এবং বিভিন্নভাবে শরীরের ক্ষতি করতে থাকে। ঘুম হয় না। মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। কোনো কিছুতে একাগ্রতা নষ্ট হয়। কোনো কিছু মনে থাকে না। যেকোনো বিষয় একটু পরে ভুলে যায়। যৌন সমস্যা দেখা দেয়। আচরণে সমস্যা দেখা দেয়। স্ত্রী ও অন্যদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। সন্দেহপ্রবণতা বাড়তে থাকে। গাঁজাকে কোনোভাবে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। এ জন্য গাঁজা থেকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। শরীরকে গাঁজার প্রতিক্রিয়ামুক্ত করতে হবে। তাই গাঁজা একটি বিপজ্জনক মাদক। গাঁজা সেবন থেকে মুক্ত থাকার চিকিৎসা আছে। দ্রুত কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সমস্যা: বাজারে জিরো এডিকশন ওষুধের বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে। এটা খেলে কি কাজ হবে? এ বিষয়ে আপনাদের মতামত কী?
সমাধান: অনেক রকমের বিজ্ঞাপন বাজারে দেখা যায়। সেগুলোয় কাজ হয় কি না আমরা জানি না। যদি জিরো এডিকশনের ওষুধ পাওয়া যায় তাহলে বিশ্বজুড়ে এত মাদকাসক্ত রোগীর ছড়াছড়ি কেন? বিশ্বের বড় বড় ওষুধ গবেষণাকেন্দ্র তো এগুলো লুফে নেবে। তারা বিশ্বজুড়ে এগুলো প্রচার করবে। সে ক্ষেত্রে দেশে দেশে এত মাদকাসক্ত রোগী থাকবে কেন? কীভাবে একটা কোম্পানি এসব ওষুধের বিজ্ঞাপন দেয়, সেটা বুঝি না। এসব বিজ্ঞাপনে জনগণ প্রতারিত হবে পারে। যেকোনো সস্তা বিজ্ঞাপনে জনগণের মনোযোগ দেওয়া উচিত না। প্রতিটি ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। তাই কোনো ওষুধ কেনার আগে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সমস্যা: আমার ছেলে অনেক বছর ধরে মাদকাসক্ত। চিকিৎসা করা হয়েছে। এখন ভালো আছে। কিন্তু ঘুম হয় না। কী করতে পারি?
সমাধান: আপনার ছেলের মধ্যে এখনো মাদকের প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। তাকে কোনো মাদক বিশেষজ্ঞের কাছে নিতে হবে। শরীরের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। মনে হয় খুব বেশি সমস্যা তার নেই। ঘুম হচ্ছে না। চিকিৎসক তাকে দেখে কিছু ওষুধপত্র দেবেন। সেটা খেলে আশা করা যায় ঠিক হবে। আপনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আপনার সন্তানকে আনতে পারেন। এখানে বহির্বিভাগে ১০ টাকায় টিকিট করে দেখানো যায়।
সমস্যা: আমার সন্তানের বয়স ২১ বছর। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাদক গ্রহণ করে। বন্ধুদের বাসায় ডেকে আনে। তাদের নিয়ে বাসায় মাদক গ্রহণ করে। এ অবস্থায় কী করতে পারি?
সমাধান: আপনার সন্তানের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুন। তার প্রশ্নে ইতিবাচক উত্তর দিন। সে হয়তো বলবে মাদক খাই না। তার সঙ্গে তর্কে যাওয়া যাবে না। তাকে তার কথা বলতে দিতে হবে। মাদক গ্রহণের কথা সে কখনো স্বীকার করতে চাইবে না। কিন্তু যদি তার সাঙ্গে ভালোভাবে মিশে যেতে পারেন, তার বন্ধু হতে পারেন, ভালোভাবে বোঝাতে পারেন, তাহলে মাদক খাওয়ার কথা স্বীকার করবে। স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিকিৎসকের কাছে আনতে হবে। চিকিৎসক তার অবস্থা বুঝে ভর্তি হতে বলবেন। অবস্থা খুব বেশি খারাপ না হলে ওষুধ দিয়ে বাসায় চিকিৎসা নিতে বলবেন। অবস্থা যাই হোক না কেন আর দেরি করা যাবে না। তাকে এখনই ভালো কোনো চিকিৎসকের কাছে আনুন। তা ন হলে সে আরও বিপদের দিকে চলে যাবে।
সমস্যা: আমরা ছেলের বয়স ২৪। সে অনেক বছর ধরে মাদক নিচ্ছে। প্রায় সারা রাত জেগে থাকে। দিনে ঘুমায়। প্রচুর বমি করে। মনে হয় ঘুমের বড়ি খায়। এ ক্ষেত্রে আপনাদের পরামর্শ কী?
সমাধান: মনে হচ্ছে মাদকাসক্তের সঙ্গে তার মানসিক সমস্যা থাকতে পারে। অনেকের এ দুটো সমস্যা একসঙ্গে থাকে। এমন ক্ষেত্রে প্রথমে মানসিক রোগের চিকিৎসা করতে হবে। পরে মাদকের চিকিৎসা। কাল ক্ষেপণ না করে তাকে কোনো ভালো চিকিৎসকের কাছে আনুন। নিজেরা চিকিৎসার দায়িত্ব নেবেন না। কারও যখন কোনো বড় অসুখ হয় তখন নিশ্চয়ই নিজের চিকিৎসা করি না। কোনো না কোনো ভালো ডাক্তারের
কাছে যাই। মাদকাসক্ত সড়ক দুর্ঘটনার থেকেও বিপজ্জনক সমস্যা। তাই কেউ মাদকাসক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে আনতে হবে। অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাকে ডাক্তারের কাছে আনুন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটসহ যেকোনো সরকারি হাসপাতালে তাকে নিয়ে যান।
কয়েকজন মাদকমুক্ত তরুণের কথা: বাবা-মায়েরা তাদের মতো করে কাজ করেন। আমাদের বুঝতে চেষ্টা করেন না। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের ভালো লাগা মন্দ লাগার কোনো মূল্য দেন না। বিভিন্নভাবে আমরা হতাশ হতে থাকি। একপর্যায়ে মাদক গ্রহণ করি। বাবা-মাকে বিশেষভাবে সন্তানদের সময় দিতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের সঙ্গে খোলামেলা মিশতে হবে। আমাদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। আমাদের জীবন কীভাবে আমরা দেখতে চাই, বাবা-মাকে এ বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আমরা যখন কোনো ভালো কাজ করি তখন সে কাজের প্রশংসা করতে হবে। তাহলে আমরা ভালো কাজ করতে আগ্রহী হই।
তবে আমদের বাবা-মা আমাদের শেষ পর্যন্ত বুঝেছেন। তাঁরা রাত-দিন আমাদের ভালো করার জন্য চেষ্টা করেছেন। আমরাও হতাশ হতে হতে বুঝতে পেরেছি মাদক নিয়ে একজন মানুষ তার জীবন শেষ করতে পারে না। মাদকের আগের জীবনটা অনেক সুন্দর ছিল। আমরা মানুষের জীবনে ফিরে আসতে চেয়েছি এবং সফল হয়েছি ।