‘মেয়ে মানুষ নয়, মানুষ হিসেবে বাঁচুন’

বর্ষা রানীর বাবা ভ্যান চালাতেন, কিন্তু বয়স বেশি হওয়ায় আর চালাতে পারতেন না। ফলে মাকে অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালাতে হতো। কিন্তু মায়ের আয়ে সংসার চলত না। তাই মায়ের সঙ্গে দিনমজুরি করতে হতো বর্ষাকেও। এতকিছুর পরও থেমে যাননি বর্ষা। কঠোর পরিশ্রম করে ২০১০ সালে মাধ্যমিক ও ২০১২ সালে উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পান। নির্বাচিত হন ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির জন্য। এই শিক্ষাবৃত্তির সহায়তায় তিনি উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক (সম্মান) পর্যায় সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি লালমনিরহাট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ধরেছেন সংসারের হাল। বাবা-মায়ের হাতকে করেছেন শক্তিশালী। নারী দিবসের মাসে বর্ষা রানী তাঁর এই দীর্ঘ পথ-যাত্রার অনুভূতিকে তুলে ধরেছেন নিজের ফেসবুক পেজে। তাঁর এই লেখাটি তুলে ধরছি।

অদম্য মেধাবী বর্ষা রানী।

ফেসবুকে লেখা বর্ষা রানীর পোস্ট:

আমার জন্মের সময় খুব সম্ভবত কেউ খুশি হয়নি। কারণ আমি আমার মা-বাবার পঞ্চম কন্যা ও ষষ্ঠ সন্তান। প্রথম একটি কন্যা সন্তানের পর একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয় আমার মা-বাবার। প্রচলিত অর্থে যাকে বলে সুখী পরিবার। কিন্তু তাঁদের আর একটি ছেলে চাই। কারণ ছেলেসন্তান মা-বাবার দুঃসময়ের অবলম্বন, ভবিষ্যতের নিরাপত্তা। গতানুগতিক সামাজিক নিয়মে মেয়েরা সে নিয়মের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু মা-বাবার সে আশায় গুড়ে বালি! ছেলের আশায় আশায় পরপর আরও তাঁদের তিনটি কন্যা সন্তান জন্ম হয়! আমার ইমিডিয়েট দিদি পর্যন্ত তাঁদের সেই আশাটা জিইয়ে ছিল। কিন্তু সেও (ছোটদি) যখন তাঁদের আশা পূরণে ব্যর্থ হলো তখন তাঁরা সিদ্ধান্ত নিল যে আর তাঁদের ছেলে চাই না। ঠিক তার কিছুদিন পর সম্পূর্ণ আন-ওয়ান্টেড আমি এলাম তাঁদের ঘর অন্ধকার করে। আমি, মানে মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে এই পরিস্থিতিতে তাঁদের ঘর 'আলোকিত' করবার বিষয়টা তখন ছিল সত্যিই বিলাসিতা। কে খুশি হয়েছিল তখন আমাকে নিয়ে!! সত্যিই তো খুশি হওয়ার কথা না! এমনিই তাদের পরিকল্পিত না, তা-ও আবার মেয়ে!!! শুনেছি আমার জন্মের পরে আমার ঠাম্মা এসে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "এবার কি...?" মানে মেয়ে নয়তো! মা পরিহাস করে বলেছিল "কপালী!!"(হতভাগ্য অর্থে)।

অদম্য মেধাবী বর্ষা রানী।

এই কিছুদিন আগে আমার মেজ দিদি বলে "সেদিন হয়তো অলক্ষ্যে বসে বিধাতা মায়ের সেই কথাটা (কপালী) শুনেছিলেন।" দিদির এ কথা বলার কারণ হলো, প্রতিনিয়ত প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে মোকাবিলা করে পরপর আমার সফলতা অর্জন। ভবিষ্যতে আর কিছু করতে পারব কি-না জানি না। কিন্তু আজ আমি যে অবস্থানে আছি সাধারণত আমার এ অবস্থানে থাকবার কথা নয়। যেখানে থাকবার কথা সে কথা না হয় আরেকদিন বলব। আজ শুধু এটুকুই বলব যে, ছেলে সন্তান যদি হয় বাবা-মায়ের ভবিষ্যতের নির্ভরতা, তবে আজ আমি আমার মা-বাবার ছেলে সন্তান হতে পেরেছি। প্রতি মাসে বেতন পাওয়ার পর যখন বাবাকে টাকা পাঠাই তখন হয়তো বাবা মনে মনে ভাবেন, ভাগ্যিস তুই এসেছিলি! আর আমি মনে মনে ভাবি.. জন্মের সময় খুশি করতে পারিনি তো কি হয়েছে? এখন তো পারছি। জন্মের সময় যার আগমনে সবাই খুশি হয়, তার তো কোনো ক্রেডিট থাকে না, থাকে পরিবেশ-পরিস্থিতির।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সকল নারীর প্রতি আহবান.. পরিস্থিতি-নির্ভর সুখের বা খুশির কারণ হওয়ার চেয়ে নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলুন যেন নিজের এবং দেশ ও দশের স্থায়ী সুখের কারণ হতে পারেন। তা না হলে পরিস্থিতি প্রতিকূলে গেলে সুখ বা খুশি উবে যেতে সময় লাগবে না। মেয়ে মানুষ নয়, মানুষ হিসেবে বাঁচুন।