‘কাজের পারিশ্রমিক দিয়ে পড়াশোনার খরচ চালাতাম’

প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে।

বাগেরহাটের মংলা উপজেলার মিঠাখালী গ্রামে বাড়ি মো. ইব্রাহিম হোসেনের। বাবা কাঠমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাতেন। বাবার সঙ্গে ঘর বাধার কাজে ইব্রাহিমও সহযোগিতা করতেন। এভাবেই কোনোমতে চলত মা-বাবা ও ৭ ভাই-বোনের বড় সংসার। ২০১৯ সালে করোনা শুরুর আগে বাবা মারা যান তাঁর।

বাবার সঙ্গে কাঠমিস্ত্রি কাজে সহযোগিতা করা ইব্রাহিম হোসেন ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্তদের একজন। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এখন সরকারি খুলনা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টর পদে চাকরি করছেন। ২০২১ সালের জুলাই মাসের ১ তারিখ এখানে যোগদান করেছেন তিনি।

অদম্য মেধাবী ইব্রাহিম হোসেন সাহস নিয়ে প্রতিকূলতা অতিক্রম করেছেন এবং সফলও হয়েছেন। তাঁর এই সফলতার গল্প ওঠে আসে ১০ মার্চ ২০২২,বৃহস্পতিবার, বিকেল ৪টা ৩০মিনিটে প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।

ছোট্ট ইব্রাহিম পড়াশোনা করতে শুরু করল, পরে এখন ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টর পদে চাকরি করছেন, পুরো গল্পটা শুনতে চাই। এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘ধন্যবাদ জানাচ্ছি প্রথম আলোকে আমাকে নিয়ে এ রকম একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য। প্রথম আলোকে সারপ্রাইজ দেওয়ার কিছু নেই, প্রথম আলো অনেক আগেই আমাকে সারপ্রাইজ করে দিয়েছে। যখন আমি মাধ্যমিকজিপিএ-৫ পাই তখন থেকে অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি অনার্স শেষ অবদি আমাকে আর্থিক, মানসিকভাবে পরামর্শ দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য।’

প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে।

পরক্ষণেই তিনি যোগ করেন, ‘প্রথমে পড়াশোনার তেমন আগ্রহ ছিল না। কারণ এ গ্রামে পড়াশোনার প্রতি তেমন সচেতন ছিল না। পড়াশোনা করে চাকরি করব এ রকম চিন্তাও হতো না। সারা দিন ঘুরে বেড়াতাম। অনেক বড় হয়ে স্কুলে গেছি, মা নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম বছর ফেল করি। পরের বছরই আবার রোল এক হয় আমার। এভাবে কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন ‍শুরু হয়। এখান থেকে প্রাইমারি শেষ করে মাধ্যমিক স্কুলে যাই। কিন্তু বাবা চাইত না যে পড়াশোনা করি। কারণ অভাবের সংসারে বাবা চাইত আমরা কাজ করি। বাবার কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন, কাঠ ও টিন দিয়ে ঘর তৈরি করতেন। বাবা চাইতেন যেন হাতের কাজটা শিখে রাখি। আমাদেরও নিয়ে যেতেন এই কাজে। তবে কাজের যে পারিশ্রমিক সেটা আবার আমাদের দিয়ে দিত। সেই টাকা দিয়ে আমি পড়াশোনার খরচ চালাতাম।’

ইব্রাহিম জানানেল, ‘আমার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহটা বেড়ে যায় মাধ্যমিক পর্যায়ে এসে। তবে সমস্যায় পড়ি যখন নবম শ্রেণিতে ওঠি। কোন বিভাগ নিব সেটা নিয়ে। কারণ বিজ্ঞান বিভাগে অনেক খরচ। সত্যি কথা বলতে, একটা সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর কেনার সামর্থ্য ছিল না। আমার মনে আছে, একটা মুরগি বিক্রি করে এটা কিনেছিলাম। এ সময় আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েন ইব্রাহিম।’

আমার মুখস্থ বিদ্যায় ভয় ছিল। তাই মানবিকে না গিয়ে বিজ্ঞান বিভাগেই ভর্তি হই। তবে আমাদের গ্রামের স্কুলে বিজ্ঞানের ভালো শিক্ষক ছিল না। যারা ভালো শিক্ষার্থী ছিল এবং টাকা-পয়সা আছে মংলায় গিয়ে বিজ্ঞানে ভর্তি হত। গ্রামের স্কুলে তেমন হতো না। তারপরও আমার শিক্ষকদের সহযোগিতায় আমি প্রচণ্ড আগ্রহ পাই। কঠোর পরিশ্রম শুরু করি। টেস্টে খুব ভালো ফল করি আমি। এতে শিক্ষকেরা আরও অনুপ্রেরণা দিলেন।

প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠান।

বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না ইব্রাহিমের। কেরোসিনে বাতিতে পড়তেন। ইব্রাহিম যাতে অনেক রাত পর্যন্ত পড়তে পারেন সে জন্য স্কুল থেকে একটা চার্জার লাইট কিনে দেওয়া হয়। বলা হয় সকালে স্কুলে যাওয়ার পর স্কুলে চার্জ দেবে, আসার সময় নিয়ে আসবে। এই অনুপ্রেরণাগুলো তাঁকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বলে জানান।

স্বপ্নটা কখন দেখলেন যে ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টর হবে জানতে চাইলে জানান, শেষের দিকে বাবা বলতেন, ‘আমার একটা ছেলে যদি শিক্ষিত হয় তাহলে পরিবারের অনেক কাজে সাহায্য করতে পারত। কিছু জমি উদ্ধার করতে পারত। সেটাতো হলো না। বাবা মারা গেছেন ২ বছর হলো। যাই হোক, আমি পড়াশোনা করে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পাই। অনেক পুরোনো স্কুল হলেও আমিই প্রথম এই স্কুল থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী। তাই পুরো স্কুল সহ কয়েক গ্রামের লোক আমাকে চিনত।

কিন্তু আমি যখন কলেজে যাই তখন বুঝতে পারি আমার বেসিক অনেক দূর্বল। আমার গ্রামের স্কুলের শিক্ষকদের অন্তুরিকতা অভাব ছিলো না। তবে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো যেভাবে অধুনিক উপায়ে পড়াতে হয় সেটা আমি গ্রামের স্কুলে পাই নি। তাই মংলা কলেজে গিয়ে দেখি সবাই ভালো ভালো স্কুল থেকে এসেছে, সেখানে আমি কিছুই না। তখন আমার স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক যিনি মংলায় ভালো ভালো স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়াতেন, তিনি আমাকে ঐ ভালো শিক্ষার্থীদের সাথে বিনা বেতনে পড়াতেন। আমি ৫-৭কিমি সাইকেলে গিয়ে পড়তাম। এর কারণে অনেক কিছু শিখেছি।’

পরে কলেজে যাওয়ার পর কঠিন মনে হলেও প্রথম আলোর বৃত্তি আমার চলার পথ সহজ করে দেয়। তখন আমার বাবাও নানাভাবে সহযোগিতা করতে লাগেলেন। এমনকি প্রথম আলো সংবর্ধনা আমি বাবাকে ঢাকায় নিয়ে যাই। তিনি অনেক খুশি হন। এর পর থেকে কষ্টের দিন অনেকটা শেষ হয়. পড়াশোনায় মনোনিবেশ করি।এভাবে এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পাই। আমাকে আবার স্নাতক পর্যায়ের জন্য শিক্ষাবৃত্তি অব্যাহত রাখে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি। পরে মেডিকেলে চেষ্টা করলাম। শেষে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। এখানে থেকে অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছি। এরপর এই চাকরিতে যোগ দিলাম। আশা আছে আরও ভালো কিছু করার- বললেন ইব্রাহিম।

আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্নটা কি, এখন ইব্রাহিমকে নিয়ে মা-বাবা, পরিবারের লোকজনের অনুভূতি কি জানতে চাইলে তিনি জানান, পরিবারের লোকজন ছোট থেকেই অনেক ভালোবাসে আমাকে। প্রতিবেশীসহ সবাই অনেক ভালোভাবে দেখে আমাকে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে আরও বড় কোনো পজিশনে গিয়ে সেবামূলক কাজ করতে চাই। তা ছাড়া আমি যেহেতু পড়াতে ভালোবাসি সে জন্য আমার ইচ্ছা আছে, অনলাইনে মানুষের উপকারে আসবে এ রকম শিক্ষামূলক কিছু করব।’

আর এখন যারা অদম্য মেধাবী আছেন তাদের উদ্দেশ্যে ইব্রাহিব বলেন, ‘পড়াশোনার টাকা ভূতে যোগায়। অর্থের অভাবে পড়াশানা থেকে থাকে না। স্বপ্নের সাথে ইচ্ছাশক্তি থাকতে হবে। ঐ যে এপিজে আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন ‘স্বপ্ন সেটা না যেটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন সেটা যেটা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না’। সুতরাং স্বপ্নের সঙ্গে পরিশ্রম করতে হবে। তাই সবার মধ্যে যদি একনিষ্ঠ পরিশ্রম থাকে তবে সবাই দেশে ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করবে অবশ্যিই।’