স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পরিবার ও গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করতে চাই

আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী অঞ্জলী রানী ভৌমিক।

মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার এলবিটিলা চা বাগানের মেয়ে অঞ্জলী রানী ভৌমিক। বাবা অনিল কুমার রেলী ছিলেন চা বাগানের শ্রমিক কিন্তু পা ভেঙে যাওয়ার পর থেকে তিনি আর কাজ করতে পারতেন না। মা সারথী রানী রেলী চা শ্রমিকের কাজ শুরু করেন। তিন ছেলেমেয়ে সহ সংসার চালানোর সম্বল প্রতিদিন ১২০ টাকা। পরিবারের সামর্থ্য কম ছিল কিন্তু চোখে স্বপ্নের কোন কমতি ছিলোনা। সন্তানদের প্রতি পরিবারের একটাই কথা ছিল, পড়াশোনা করতে হবে, স্বাবলম্বী হতে হবে। এই যে জীবনের এতো কষ্ট, পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলে, সেই কষ্ট থেকে মুক্ত পাওয়া যাবেনা। ছোটবেলা থেকে কম কষ্ট করেননি অঞ্জলী। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ছিলো ৩ কিলোমিটার। প্রাথমিক স্কুলে পড়াশোনা শুরু করা ছোট্ট অঞ্জলী হেঁটে হেঁটেই স্কুলে যাওয়া আসা করতেন। অঞ্জলীদের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিলোনা। কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়াশোনা করতেন।

এসএসসি পরীক্ষা শেষে কলেজে যখন উঠলেন, তখন যে কেবল বাড়ি থেকে কলেজের দূরত্ব বেড়েছে তাই নয়। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধ। প্রতিদিন ২০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে ক্লাস করা, পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার যুদ্ধ। ছোটবেলা থেকে কষ্টের সাথে যুদ্ধ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া অঞ্জলীর হেরে যাওয়ার পাত্রী ছিলেন না। কষ্টে সৃষ্টে একটা সাইকেল কিনে দেওয়া হলো তাঁকে। ৩ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে মূল সড়কে পৌঁছাতেন। তারপর সেখান থেকে বাসে করে কলেজে। ছোট থেকেই অঞ্জলী স্বপ্ন দেখতেন তিনি ডাক্তার হবেন। কলেজের ক্লাস শেষ প্রাইভেট পড়ে আবার সেই বাস, সাইকেলের পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ৭-৮ টা বেজে যেতো। বাড়ি ফিরে আবার অন্যকে প্রাইভেটও পড়াতেন। সেই টিউশনির টাকা দিয়ে নিজের খরচ চালাতেন। তখনও বাড়িতে বিদ্যুৎ আসেনি। পড়াশোনা করতেন কেরোসিনের ল্যাম্পের আলোয় । কিন্তু এতো কষ্ট করেও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ধাক্কা খেলেন অঞ্জলী। পরীক্ষার ফলাফল সেই অর্থে ভালো হলোনা। কোন মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলেন না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের লিখিত পরীক্ষায় সুযোগ পেলেও ভাইভাতে বাদ পড়ে গেলেন। মন ভেঙে গেছিলো সেদিন কিন্তু পাশে পেয়েছিলেন পরিবারকে।

আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী অঞ্জলী রানী ভৌমিক।

এর মধ্যেই জানতে পারলেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডাব্লিউ) কথা। জানলেন সেখানে বিনামূল্যে পড়ার সুযোগের কথা। ভর্তি পরীক্ষা দিলেন এইউডাব্লিউতে। ভাগ্যদেবী মুখ তুলে চাইলেন এইবার। শুধু যে এইউডাব্লিউতে ভর্তির সুযোগ পেলেন অঞ্জলি তাই নয়। চার বছরের স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করার জন্য আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তির জন্যও নির্বাচিত হলেন। ২০২০ সাল থেকে এইউডাব্লিউতে পড়াশোনা করা অঞ্জলী ভবিষ্যতে কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়তে চান। অঞ্জলী বলেন, 'শত কষ্টের মধ্যেও আমার পরিবার আমার পড়াশোনা বন্ধ করেনি। আমার পাশ থেকে কখন সরে যায় নি। আমি আমার পরিবারের পাশে থাকতে চাই সবসময়। এখানের (এইউডাব্লিউ) পড়াশোনা শেষ করে আমি মাস্টার্স আর পিএইচডি করতে চাই দেশের বাইরে থেকে। আমার স্বপ্ন আমি গুগলে কাজ করবো। কোন কারণে যদি আমি দেশের বাইরে যেতে না পারি, তাহলে বিসিএস পরীক্ষা দিতে চাই। স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চাই, নিজের গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করতে চাই।'

লেখক: সমন্বয়ক, প্রথম আলো ট্রাষ্ট