‘এত কষ্টের মাঝেও বাবা আমার পড়াশোনা বন্ধ করেননি, বাবার পাশে থাকতে চাই’

আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের 'অদ্বিতীয়া' শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত আফরিন মৌ।

হবিগঞ্জের চাকলাপুঞ্জি চা বাগানের মেয়ে আফরিন মৌ। বাবা বাগানের চা শ্রমিক আর মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলেন মৌ। সেই ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা আর কষ্ট যেন আফরিনের কাছে এক সুতোয় বাঁধা ছিল। চা বাগানের এলাকার স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর হাই স্কুলে ভর্তি হলেন। কিন্তু বাড়ি থেকে স্কুল বেশ দূর। বাড়ি থেকে অনেক খানি পথ হেঁটে, তারপর গাড়ি করে সেই সকালে স্কুলে যেতে হত। আর ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। আবার বাড়ি ফেরার পথে, অনেক সময় শিক্ষার্থী সংখ্যা কম থাকলে গাড়ি থামত না। পরিবারের সেই আর্থিক অবস্থা ছিল না যে, মেয়েকে প্রাইভেট পড়াবে।

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বলা যায় কারও কোন রকম সহায়তা ছাড়াই পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন আফরিন। সেই কথা বলতে বলতে কান্না ধরা গলায় বলছিলেন, ' আমি যখন দশম শ্রেণিতে উঠলাম, তখন এলাকার এক বড় আপু আমাকে পড়াশোনায় সাহায্য করেছিলেন। তখন থেকেই আমার অংকে, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নে বেশ উন্নতি হতে থাকে। কিন্তু ইংরেজির দুর্বলতা তেমনভাবে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। নবম শ্রেণিতে অসেত পড়া দশম শ্রেণিতে উঠে পড়তে হয়েছে। কারণ একা একা আমার পক্ষে নবম শ্রেণির সব পড়া বোঝা সম্ভব ছিল না। আমি যদি ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার জন্য অন্তত এই সাহায্যটুকুও পেতাম, যদি সামান্য একটু নির্দেশনা পেতাম, তাহলে আজকে নিজেকে আরও গুছিয়ে নিতে পারতাম। এত কষ্ট মনে হয় আমাকে করতে হত না।' বাড়ির বড় মেয়ে, বড় বোন সব দায়িত্ব সামলে স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে জিপিএ-৪.৬৭ পেয়ে অবশেষে কলেজের পথে পা বাড়ালেন আফরিন।

আমার এলাকার ছেলেমেয়েরা এখনো পড়াশোনার জন্য এখনো সঠিক দিক নির্দেশনা পায় না। আমি তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চাই।

আফরিন বলেন, 'কলেজে পড়ার সময় একটু ভালো ফলাফলের জন্য যা যা প্রয়োজন, আমার বাবা তাঁর সর্বোচ্চ দিয়ে সেই চেষ্টা করেছেন। সব বিষয়েই আমি ভালো করে নিজেকে তৈরি করতে পেরেছি। আসলে পড়াশোনা কি, এই বিষয়টা আমি নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বুঝেছি। কারণ পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা আমি এই সময়টাতেই পেয়েছি।' আফরিন যখন কলেজে ভর্তি হন, তখনই চাকলাপুঞ্জি চা বাগানের তৎকালীন ম্যানেজার আফরিনের বাবাকে বলে রেখেছিলেন, আফরিন যেন অবশ্যই এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে (এইউডব্লিউ) ভর্তি পরীক্ষা দেয়। তিনিই আফরিনের বাবাকে দিয়ে ভর্তি ফরম পূরণ করান।

কিন্তু আফরিন পরীক্ষা যে দেবেন, পরীক্ষার নিয়ম কি, কোন কোন বিষয়ের ওপর পরীক্ষা হবে তা সম্পর্কে কোন কিছুই জানা ছিল না। পরীক্ষা দিতে গিয়ে জানলেন, গণিত আর ইংরেজির ওপর পরীক্ষা হবে। কি আর করা। গণিত আর ইংরেজিতে যতটুকু সম্ভব নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আসেন। ভাইভার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, বাগানের বড় ভাই যারা সকলকে পড়াশোনার কাজে সহায়তা করেন, তাঁদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলে চর্চা করেছেন। শেষমেশ সব বাঁধা পেড়িয়ে আফরিন এইউডব্লিউতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। সেই সঙ্গে পান আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের 'অদ্বিতীয়া' শিক্ষাবৃত্তি।

ভবিষ্যতে কি করতে চান জানতে চাইলে আফরিন বলেন, ' আমি কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে চাই। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখি। বাবা এত কষ্টের মাঝেও আমার পড়াশোনা বন্ধ করেননি। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাবার পাশে থাকতে চাই। আমার আজকের এই পর্যন্ত আসার জন্য আমি যাদের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছি তাঁদের মুখে হাসি ফুটাতে চাই। তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই। আমার এলাকার ছেলেমেয়েরা এখনো পড়াশোনার জন্য এখনো সঠিক দিক নির্দেশনা পায় না। আমি তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চাই।'