স্বাবলম্বী হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান মোহিনী

মোহিনী আফরোজের বাড়ি রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার বিশ্বনাথ গ্রামে। ৩ বোন ১ ভাইরে মধ্যে মোহিনী সবার বড়। তাঁর বাবা কৃষক, মা গৃহিণী। অভাব অনটনের সংসারে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রীরা যে সব বিষয়েই প্রাইভেট পড়তে হয়, মোহিনী সেই সুযোগ তেমন পাননি। নিজের চেষ্টায় এসএসসিতে জিপিএ-এ, এইচএসসিতে-এ মাইনাস পেলেন। এরপর তাঁকে আর পড়ালেখা করানোর মতো আর্থিক অবস্থা ছিল না পরিবারের। তাই উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর চট্টগ্রামে এসে একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন তিনি। কিন্তু তিনি থেমে যাননি। সব বাধা অতিক্রম করে অদম্য ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন মোহিনী। তিনি ২০১৮ সালে আইডিএলসি ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছেন। শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে স্নাতক পড়ছেন চট্টগ্রামে অবস্থিত এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে। বর্তমানে তিনি জনস্বাস্থ্য বিভাগে তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।

মোহিনী আফরোজই তাঁর পরিবারে গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে পড়া প্রথম নারী। তাঁর এই গ্র্যাজুয়েট করতে আসার পেছনের নানা গল্প ও বর্তমান পরিস্থিতির যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’ নামক অনলাইন অনুষ্ঠানে। গত ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার, বিকেল ৫টা ৩০মিনিটে প্রথম আলো ট্রাস্ট এই অনলাইন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

মোহিনী জানালেন, ‘প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বাড়ির পাশেই পড়াশোনা করেছি। পরে অনার্সে মহসিন কলেজে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হই। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারিনি। তখন একটি পোশাক কারখানায় চাকরি শুরু করি। ওখানেই এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ) সম্পর্কে জানতে পারি, পরে পরীক্ষা দিয়ে আরএমজি কোটায় ভর্তির সুযোগ পাই। আমার চাকরিটা চলে যায়। কিন্তু চাকরিটা চলে যাওয়ায় ভর্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আমি অনেক হতাশায় পড়ে ভর্তির আশা ছেড়েই দেই। তখন এইউডব্লিউ থেকে একটা ফোন আসে। ফোনে বলা হয়, ‘তোমার ফল ভালো হওয়ায় প্রথম লিস্টে নাম এসেছিল। সে জন্য প্রথম আলোর বৃত্তিটা দিয়ে তোমাকে নিতে চাই।’ তখন আমি খুশিতে কেঁদে ফেলি।’

এইউডব্লিউতে ভর্তির হওয়ার বিষয়ে মা-বাবার অনুভূতি কেমন ছিল জানতে চাইলে জানান, ‘আসলে এইচএসসির পর আমার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পরেই আমি পোশাক কারখানায় চাকরি নিই। যখন ভর্তি সুযোগ পেলাম তখন মা-বাবা অনেক খুশি হয়েছেন। তবে আমার স্বামী অনেক সাপোর্ট করেছে। ’

সংসার সামলিয়ে ৩য়বর্ষের পড়াশোনা সবকিছু কিভাবে ম্যানেজ করেন? এর উত্তরে মোহিনী জানান, ‘আসলে প্রথমে মনে করছিলাম এইউডব্লিউতে বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কীভাবে চলব! পরে দেখলাম, এখানে সবাই সবাইকে সম্মান করে, মিলিয়ে চলে। তখন মনে হলো, আমিও পারব। আসলে আমি পেরেছি। এখন আমি কথা বলতে পারি।’

আমি অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখি। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে চাই। মানুষের সেবা করতে চাই— মোহিনী আফরোজ।

একজন আত্মবিশ্বাসী নারী হিসেবে কেমন লাগে জানতে চাইলে মোহিনী বলেন, ‘আমি অনেক লাজুক ছিলাম। এখন অনেক পরিবর্তিত হয়েছি। আমার স্বামীও বলে, ‘তুমি এগিয়ে যাচ্ছ।’ আসর ওর কারণেই আমি আরও সাহস পাই।’

সংসার, পড়াশোনার চাপ, অ্যাসাইনমেন্টের বিষয়ে মোহিনীর সোজা উত্তর ‘আসলে এগুলো আমার কোনো চাপ মনে হয় না। কারণ আমার স্বামী শ্বশুর-শাশুড়ি সহযোগিতা করেন। যার কারণে আমি আমার স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে পারছি।’

এখন যারা অদ্বিতীয়া আছে তাদের জন্য মোহিনী বলেন, বাংলা মিডিয়াম থেকে এসে নতুন এই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে সকল প্রোগ্রামে যোগ দিতে হবে। কথা বলতে হবে, পারফর্ম করতে হবে। কারণ এই এক্সট্রা কারিকুলার এ্যাক্টিভিটিগুলো নিজেকে তৈরি করতে সহায়তা করে। চাকরি ক্ষেত্রেও অনেক সহায়ক হয়।’

আপনার স্বপ্নটা কি? এ ক্ষেত্রে মোহিনী বলেন, আমি অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখি। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে চাই। মানুষের সেবা করতে চাই। বাল্যবিয়ে, অকাল গর্ভধারণ এগুলো প্রতিরোধের বিষয়ে কাজ করতে চাই। এবং অবশ্যই স্বাবলম্বী হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত চাই।’