জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে নিজেকে দক্ষ করছেন সুহি

আইডিএলসি ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত সুমাইয়া তাবাসসুম সুহি।

টাঙ্গাইলের করটিয়া গ্রামের মেয়ে সুমাইয়া তাবাসসুম সুহি। অসচ্ছলতার বাধা পেরিয়ে অদম্য ইচ্ছা নিয়ে তিনি এগিয়েছেন। সুহি ২০১৭ সালে আইডিএলসি ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি পান। শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে পাবলিক হেলথে স্নাতক শেষ করেন চট্টগ্রামে অবস্থিত এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন থেকে। বর্তমানে তিনি কাজ করছেন ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবীইং বাংলাদেশ নামক প্রতিষ্ঠানে প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর হিসেবে।

সুহি জানালেন, তিনি তাঁর গ্রামের প্রথম গ্র্যাজুয়েট সম্পন্নকারী নারী। তাঁর পরিবার প্রথম গ্র্যাজুয়েট হওয়া ও বর্তমান পরিস্থিতির যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’ নামক অনলাইন অনুষ্ঠানে। গত ২৬ অক্টোবর ২০২২, বুধবার, বিকেল ৫টা ৩০মিনিটে প্রথম আলো ট্রাস্ট এই অনলাইন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন নবীনদের র‌্যাগিং করা হয়। এখানে পুরো উল্টোচিত্র। আমি যেদিন ক্যাম্পাসে যাই ,সেদিন আমার সিনিয়ররা আমার লাগেজ রুম পর্যন্ত দিয়ে এসেছে। একটা আচরণই আমাকে সহজ করে দেয়।

সুমাইয়া তাবাসসুম সুহির পথ চলার গল্পটা জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি আমার পরিবারের প্রথম ইউনিভার্সিটিতে গেছি। আমি বেড়ে উঠেছি টাঙ্গাইলের করটিয়া গ্রামে। পড়াশোনায় খুব সিরিয়াস ছিলাম। এসএসসিতে ভালো ফল করি। পরে অনেক যুদ্ধ করে টাঙ্গাইল শহরে কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। তবে বাবা-মা আমার পড়াশোনার জন্য বাধা তৈরি করেননি। বাধা তৈরি করেছে প্রতিবেশিরা। চারপাশের মানুষ বলেছে, ‘মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও। বয়স হলে বিয়ে দিতে পারবা না।’ তবে মা এগুলো মাথায় নেয়নি। আমার মায়ের অনুপ্রেরণা না থাকলে আজকের এই অদ্বিতীয়ার অনুষ্ঠানে সুহি থাকত না।’

পরক্ষণেই যোগ করলেন, ‘কলেজে সবাই চিনত ভালো ছাত্রী হিসেবে। সব সময় রোল এক বা দুইয়ের মধ্যে ছিল। এইচএসসিতে ভালো ফল কলে মেডিকেলের জন্য প্রস্তুতি নিই, তবে ভর্তির সুযোগ পাইনি। সে বছর আর কোথাও ভর্তি হয়নি। আমার মাথায় শুধু মেডিকেল ছিল। মেডিকেলের বাইরেও যে জীবন আছে সেটা বুঝিনি। পরে মনের বিরুদ্ধে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। ঠিক সেই সময়টাতে আমার এক বন্ধু, যে আগের বছর এইউডব্লিউতে ভর্তি হয়েছিল, তার কাছে জানতে পেরে আবেদন করি। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভার জন্য ডাক পাই। ভর্তি হই।

আইডিএলসি ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত সুমাইয়া তাবাসসুম সুহি।

করটিয়া থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার যুদ্ধটা কেমন ছিল জানতে চাইলে সুহি জানান, ‘অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। তা ছাড়া ভাইভার পর জানানো হলো, ভর্তির জন্য এক হাজার ডলার দিতে হবে। এটা আমার বা আমার পরিবারের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না। পরে আমাকে জানানো হয়, ফুলফ্রি স্কলারশীপ পেয়েছি। আমাকে ৪৮হাজার টাকা দিতে হবে, যেটা অনেক টাকা আমার জন্য। বাবাকে বলেছি, আমি এখানে চান্স পেয়েছি। তিনি শুনে শুধু বলেছে,চান্স পেয়েছ, ভর্তি হও—এটুকুই। এদিকে ভর্তির তারিখ শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমার হাতে কোনো টাকা নেই। যেদিন ভর্তির শেষ দিন ছিল—সেদিন আমার এক চাচাতো বোন আমাকে বিশ্বাস করে টাকাটা দিয়েছিল। এটা ছিল আমার জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। যদিও পরে টাকাটা পরিশোধ করেছি।’

অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন নবীনদের র‌্যাগিং করা হয়। এখানে পুরো উল্টোচিত্র। আমি যেদিন ক্যাম্পাসে যাই ,সেদিন আমার সিনিয়ররা আমার লাগেজ রুম পর্যন্ত দিয়ে এসেছে। একটা আচরণই আমাকে সহজ করে দেয়। এইউডব্লিউর মাল্টি-কালচারাল ডাইভার্সিটি থেকে অনেক কিছু শিখেছি। লিডারশিপ, সিম্প্যাথি, এম্প্যাথি, মানিয়ে নেওয়া, খাপ খাওয়ানো —এগুলো শিখেছি। তা ছাড়া প্রফেসরগণ এত আন্তরিক—যেকোনো সমস্যা নিয়ে যাওয়া যায়, সমাধান পাওয়া যায়। চাপ দিয়ে নয়, সব সময় সহজ করে দেন তাঁরা। সবকিছু মিলে, এখন আমি অনেক কন্ফিডেন্ট।

অদ্বিতীয়ার গল্প অনলাইন অনুষ্ঠানে আইডিএলসি ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত সুমাইয়া তাবাসসুম সুহি।

এখন কি স্বপ্ন দেখেন জানতে চাইলে জানান, ‘স্নাতক শেষ করা পর নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করছি। একটা চাকরি করছি। এখন দেশে বা দেশের বাইরে থেকে এমপিএইচ করার ইচ্ছা আছে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করব—সে জন্য যা করা দরকার তা করব। নিজের দক্ষতা বাড়াতে হবে। আপাতত নিজেকে একটু স্টেবল করার চেষ্টায় আছি। পরে আবার ভাবব। নভেম্বর ২০২২ থেকে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার-এ জেন্ডার নিয়ে কাজ শুরু করছি। নতুন অভিজ্ঞতা দরকার। আপাতত তাড়াহুড়া করছি না। জীবনে অনেক দৌড়াইছি। তবে অনেক দূর যেতে হবে আমায়…।’

উল্লেখ্য, নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ২০১২ সাল থেকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং প্রথম আলো‘ফার্স্ট ফিমেল ইন দা ফ্যামিলি স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ নামে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান শুরু করে। পরিবারের প্রথম নারী অথচ অসচ্ছল, যিনি উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ গঠনে আগ্রহী, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের এ রকম ১০ জনকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তায় প্রথম আলো ট্রাস্ট এই বৃত্তির ব্যবস্থা করে। ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪২ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন।

আইডিএলসি ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত সুমাইয়া তাবাসসুম সুহি।

২০১৭ সাল থেকে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড এই শিক্ষাবৃত্তির দায়িত্ব নেয়। নতুনভাবে নামকরণ করা হয় ‘অদ্বিতীয়া’ নামে। আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সহায়তায় ৪৬ জনসহ ২০২১ পর্যন্ত মোট ৮৮ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনও তাঁদের আবাসন, টিউশন ফি সুবিধাসহ নানা সুযোগ দেয়।

অনুষ্ঠানটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।