মাদক গ্রহণ করলে পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হয়

মাদক গ্রহণ করলে কেন পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হয়? এর উত্তরে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা.মো. জোবায়ের মিয়া বলেন, ‘মাদক গ্রহণের ফলে মাদক মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় । স্বাভাবিক আবেগ নিয়ন্ত্রণ থাকে না, আমরা যাদের সঙ্গে বাস করি সবাই মিলে পরিবার। পরিবারে সুখে দুঃখে একে অন্যের পাশে থাকেন। আর যারা মাদক গ্রহণ করে তাদের আচরণ ভিন্ন হয়ে যায়। তারা সহজ কথা ভালোভাবে নেয় না, ভিন্নভাবে গ্রহণ করে। সব কথায় তারা পরিবারকে শত্রু মনে করেন। মাদক গ্রহণের ফলে তাদের টাকা পয়সার চাহিদা বেড়ে যায়, টাকা পয়সা না পেলে তারা অবাধ্য হয়ে যায়। সামাজিক বন্ধন আস্তে আস্তে ভেঙে যায়। ভাই- বোন, স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। যে ভালো কথা বলে তাকে এড়িয়ে যায়। ক্ষণিকের আনন্দ পাওয়ার জন্য মাদকাসক্ত বন্ধুকে আপন মনে করে। আত্মিক সম্পর্ক তাদের ছেড়ে দেয়। মাদক গ্রহণ করলে আচরণ পরিবর্তন হয়। ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা থাকে না । এভাবেই পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হয়।'

গত ১৬ অক্টোবর শনিবার বিকেল চারটা থেকে আধা ঘণ্টা প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে মাদকবিরোধী অনলাইন পরামর্শ সহায়তা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়কারী মাহবুবা সুলতানা। অনলাইনে মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা সভার এটি ছিল ২৯ তম আয়োজন।

মাদক গ্রহণ না করলে অনেকের সংসার চলবে না? এর উত্তরে ডা.মো. জোবায়ের মিয়া বলেন, ‘সংসার চালানোর জন্য যেই পরিবারের মাদক গ্রহণ করেন বা ব্যবসা করেন সেই সংসারে কোন শান্তি থাকেনা। মাদক ব্যবসার ফলে অশান্তি লেগেই থাকে । মাদকগ্রহণের ফলে শারীরিক মানসিক সমস্যাতো হয়। মাদক ব্যবসার ফলে সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়। ভয়ংকর পরিবেশ থাকে । আইনগত সমস্যা, শারীরিক সমস্যা, ভয়ংকর অস্বাস্থ্যকর পথ থেকে সরে আসা উচিত। নিজেদের বুদ্ধিমত্তা, পেশাগত দক্ষতা নিয়ে অন্য পেশায় যুক্ত হতে পারেন। দেশ জাতিকে ভালো কিছু দিতে পারেন। আমরা সবসময় পজিটিভ চিন্তা করব। মাদক না নিলেও সংসার চলবে।’

আমার এক ভাই ফেনসিডিল খেত। এখন মদ খায়, তার জন্য কি করব? এর জবাবে ডা.মো. জোবায়ের মিয়া বলেন, ‘অ্যালকোহলও একটি মাদক। একটি মাদক থেকে অন্য মাদকে গিয়েছেন তিনি মাদকাসক্তের মধ্যেই আছেন। অ্যালকোহল লিভারের ক্ষতি করে । অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে লিভার অকার্যকর হয়ে যায়। লিভারে পরিপাক ক্রিয়া নষ্ট হয়। প্রথমে লিভার বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে শারীরিক চিকিৎসা প্রয়োজন । চিকিৎসা নিতে হবে তারপর মনোরোগ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। সরকারিভাবে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বহি বিভাগ ও দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজের বহির্বিভাগ দেখাতে পারেন।’

সন্তানকে কীভাবে বড় করলে সন্তান মাদকের পথে যাবে না? এর উত্তরে ডা.মো.জোবায়ের মিয়া বলেন, ‘মূলত প্যারেন্টিং কৌশলটা আসল ব্যাপার। প্যারেন্টিং কৌশল নিয়মতান্ত্রিক হওয়া চাই। পিতা মাতা সন্তানকে লালন-পালন করার পদ্ধতিতে যদি ভালো হয়, স্বাস্থ্য সম্মত হয়। শিশুর শারীরিক ও মানসিক রোগের প্রতিরোধ শিশুকাল থেকে নিতে হয়। শুরু করতে হবে জন্মের আগে থেকেই গর্ভাবস্থা থেকেই। গর্ভাবস্থা থেকেই শিশুর ব্রেনের গঠন তৈরি হয়। মাকে নিয়ে আমরা চিন্তা করব। যতটুকু পারা যায় পরিবারের পরিবেশ হবে স্ট্রেসবিহীন। বাবা মায়ের উচিত হবে বাইরে থেকে এসে ঘরের শিশুদের প্রতি মনোযোগী হওয়া । গর্ভাবস্থায় মায়ের মনের অবস্থা সুস্থ থাকলে সুস্থ শিশু জন্মগ্রহণ করে। শিশুটিও ভালো থাকবে । শিশু বয়স থেকে টিকা কার্যক্রমগুলো নিতে হবে । বাবা-মার উচিত হবে বাইরে থেকে এসে ঘরে বসবাসরত পরিবারের সদস্যদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া।’

সন্তান মাদকাসক্ত কিনা বুঝব কিভাবে। সুস্থ করতে কি করব? এর উত্তরে বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি দরকার পারিবারিক বন্ধন । সবার মধ্যে নিয়ম-নীতি থাকবে, কখন কে কি করবে, ভাব বিনিময় হবে। বাবা মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক ভালো থাকলে সন্তান বিপথে যেতে পারে না। বিশ্বায়নের যুগে বাবা-মা সবাই ব্যস্ত। বাবা মায়ের সঙ্গে সন্তানের একটা গ্যাপ থাকা চলবে না। যদি দেখা যায় আপনার সন্তানের হঠাৎ করে আচার আচরণ পরিবর্তন হচ্ছে। যে ছেলেটি চোখ তুলে তাকাতো না সেই অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে । টাকা-পয়সার চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে । না বলে বাইরে থাকে, সব সময় সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে চায় না, রুমে বন্দী থাকে, দিনে ঘুমায় রাত জাগে। পোশাক-পরিচ্ছদের যত্ন নেই । তার ঘরে মাদকের চিহ্ন, রাংতা কাগজ পাওয়া যায়। তাহলে বুঝতে পারবেন সন্তান মাদক গ্রহণ করছে কিনা। তখন মনোরোগ মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। অভিভাবকের দায়িত্ব কতটা সচেতন হতে হয়। আন্তরিকতার সম্পর্ক বাড়াতে হয়।’

সরকারিভাবে মাদকের চিকিৎসা আছে কিনা? হ্যাঁ, সরকারি ব্যবস্থাপনায় কম খরচে চিকিৎসা রয়েছে। রোগীকে সশরীরে হাজির হতে হয় স্বল্প মূল্য বা নামমাত্র মূল্য এসব জায়গা থেকে চিকিৎসা নিতে পারেন ঢাকার তেজগাঁও কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বহি বিভাগ। এ ছাড়া দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর বহির্বিভাগে বিনা মূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব।

আমার এক ভাই প্রতিদিন গাঁজা খায়, কীভাবে আসক্তি কাটাবেন? উত্তরে চিকিৎক জানান, গাঁজা বা ক্যানাবিস নিয়মিত খেলে মানসিক রোগ হয় । প্রত্যাহার জনিত সমস্যা বেশি হয়। গাঁজা খেলে মানসিক রোগ বেশি হয়, অলীক কল্পনা করে। আচার-আচরণ পরিবর্তন হয়। সামাজিক কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। তাই দেরি না করে ভর্তি রেখে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা করতে হবে ৬ মাস থেকে ২ বছর চিকিৎসা করাতে হতে পারে।

আমার এক বন্ধু বিয়ার খায় সে কি করবে? এর উত্তরে ডা.মো. জোবায়ের মিয়া বলেন, ‘বিয়ারে অ্যালকোহল থাকে। দীর্ঘদিন অ্যালকোহল খেলে রোগীকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করতে হবে । কাউন্সেলিং করতে হবে। পরিবারের যদি সহযোগিতা করে তাহলে দ্রুত রোগ থেকে ভালো হবে। কাউন্সেলিং দরকার হয়। চিকিৎসা করা হলে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব।’