‘প্যারেন্টিংয়ের সবচেয়ে ভালো স্টাইল হলো গণতান্ত্রিক প্যারেন্টিং’

শিশুর বেড়ে ওঠার সময় থেকেই অভিভাবকের ভূমিকা থাকে । শিশু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বেড়ে ওঠে। প্যারেন্টিং নিয়ে কথা বলব। মাদককে ‘না ’ বলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা শপথ করাতাম। শিশুর এই ‘না’ বলাটা হুট করে আসে না। ‘না’ বলতে হলে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। দক্ষতা দরকার। আশাবাদী মন হতে হবে। ব্যক্তিগত দক্ষতা, পড়াশোনা, খেলাধুলা শিশুর আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দেয়। শিশুকালে সন্তান ঠিকভাবে বেড়ে উঠলে ওই না বলাটাও শেখে। শিশুর ব্যক্তিত্ব বেড়ে ওঠে। গত ৩০ আগস্ট ২০২২, প্রথম আলো ট্রাস্ট আয়োজিত অনলাইন মাদকবিরোধী পরামর্শ সভায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোহিত কামাল কথাগুলো বলেন।

গণতান্ত্রিক প্যারেন্টিং সন্তানের আবেগ বা মতামতকে গুরুত্ব দেয়। যেমন কোন সন্তানকে বাবা বলছে আমরা কক্সবাজার বেড়াতে যেতে চাই তোমার মতামত জানাও, কী করা যায়, ইত্যাদি।

প্যারেন্টিং প্রেগনেন্সি থেকে শুরু হয়। যে মা সন্তান ধারণ করছেন সে মায়ের মানসিক প্রস্তুতি থাকা দরকার । স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রেগনেন্সি প্ল্যান করবেন। যেখানে মা স্বস্তিবোধ করবে সেখানেই সে অবস্থান করবে। সেই মা কী বাবার বাড়ি থাকবে? না শ্বশুরবাড়ি থাকবে । মা যেন উদ্বেগের মধ্যে না থাকে। মা কে হাসি খুশি থাকতে হবে। গর্ভবতী মা যেন স্বস্তির মধ্যে থাকেন। তাহলে সুস্থ বাচ্চা হবে। সুস্থ সন্তান আশাবাদী হয় । গর্ভ পরবর্তী মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনীয় টিকা দিতে হবে। শহরের মানুষ চিন্তা করে বেশি। দেরিতে বিয়ে করে । দেরিতে বিয়ের ফলে গর্ভবতী মায়ের ডেলিভারিতে সমস্যা হয়। নিরাপদ ডেলিভারি হতে হবে । অনেকে না বুঝে বাচ্চাকে মা থেকে দূরে রাখে । গবেষণায় দেখা যায় নবজাত শিশুকে মায়ের কাছে দ্রুত যেতে দিতে হবে, শিশুকে শাল দুধ খেতে দিতে হবে। তাতে মায়ের সঙ্গে সন্তানের আত্মিক বন্ধন তৈরি হবে। এতে করে নতুন জগতে এসে শিশু শান্তি পেয়ে যায়। কমপক্ষে ৬ মাস মায়ের দুধ খাবে। মা দূরে চলে গেলে সন্তানের সমস্যা হয় ।

শিশু যা চাইবে, তাই দিব। অভিভাবক হিসেবে কি করব? এর উত্তরে মোহিত কামাল বলেন শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। শিশুর নিরাপত্তা বোধ থাকতে হবে। পর্যাপ্ত শিশুকে ঘুমাতে দিতে হবে। নবজাত শিশু কমপক্ষে ১৮ ঘণ্টা ঘুমাবে। সক্রিয় খেলাধুলা করবে। শিশুকে শান্তির পরিবেশ দিতে হবে। জাপানের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। জাপানের এক নাগরিক আমাকে বলেছে, জাপানিরা দুই জায়গায় লালবাতি দেখলে থেমে যায়। রাস্তায় লাল বাতি জ্বললে গাড়ি থেমে যায়। আরেকটি হলো বাবা-মা, বাচ্চার সামনে কখনো ঝগড়া করে না । কোন কারণে বাবা মায়ের ঝগড়া বিবাদ হলে সামনে বাচ্চা চলে এলে বাবা-মা থেমে যায়। যদি বাচ্চা বুঝে যে, তার বাবা মাকে পেটায় বা মা কোন কারণে অশান্তিতে আছে তাহলে সেই সন্তানের মানসিক অবস্থা বাধাগ্রস্ত হবে। সন্তানকে মানবিক গুণ দিচ্ছেন কিনা। শিশুর খাদ্য পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। সুস্থ করে তাকে বেড়ে তুলতে হবে।

বাচ্চা যা চায় তাই দেব, না কি করব। এর উত্তরে মোহিত কামাল বলেন, বাবা মা হিসেবে বাচ্চার যৌক্তিক চাহিদা পূরণ করব। অযৌক্তিক চাহিদা পূরণ করব না। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে যে, অতি প্রশ্রয়ে সন্তান গোল্লায় যায়। যে সন্তান অতি প্রশ্রয় পাচ্ছে, সেই সন্তান হঠাৎ করে ক্ষেপে যাচ্ছে। জিদ করছে। সেই সন্তান বড় হয়ে মাদক গ্রহণ করতে পারে। প্যারেন্টিংয়ের সঙ্গে এটা জড়িত।

সন্তানের সঙ্গে কথা বলার সময় সন্তানের বয়সের,বোধের লেভেল এক হতে হবে। যখন আমরা কথা বলব সন্তানের কথায় মনোযোগ দিব।

কখন আমি বুঝব সন্তানকে প্রশ্রয় দিচ্ছি কিনা। এর উত্তরে মোহিত কামাল বলেন, যদি সন্তানের চাহিদা পূরণ করলেন সে বিজয় উল্লাস করল। ধরা যাক সন্তান টেবিল থেকে পানি নিয়ে খেতে পারে। কিন্তু নিজে না খেয়ে আপনার কাছে পানি চাইল । এখন আপনি যদি পানি এনে দেন তাহলে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে। সন্তান যখন কিছু চাইছে আপনি দিচ্ছেন । যখন সন্তান যখন কিছু চাইছে আপনি দিচ্ছেন না সবার নজরের আনার জন্য সে ভাঙচুর করছে । এটা অতি প্রশ্রয়ের ফলাফল। ধরা যাক বাচ্চার খিদে পেয়েছে মা হিসেবে আপনি বুঝলেন, বাচ্চাকে খাবার দিলেন । বাচ্চা মোবাইল চাচ্ছে। বাচ্চাকে মোবাইল দিচ্ছেন। কিছুদিন পর সে মোটরসাইকেল চাইল। কিন্তু আপনি দিলেন না। প্রচুর ছেলে আমাদের কাছে আসে পরামর্শের জন্য । মোটরসাইকেল চাইছি। বাবা-মা দেয় না। মাসে অন্তত আমরা ৩০ জন এরকম পাই। আমরা পরামর্শ দেই প্রতি সপ্তাহে দুই/তিন দিন পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে সরেজমিনে গিয়ে আমাদের রিপোর্ট করবে। এভাবে বললে সে নিজে বুঝবে মোটরসাইকেল চালালে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হতে পারে। ধরা যাক একটি শিশু পার্কে যাওয়ার দৌড়াদৌড়ি করেছে। তারপর আপনার কাছে আইসক্রিম চাইল। কিন্তু আপনি বললেন আইসক্রিম খেলে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে, কাশি হবে, আইসক্রিম দিলেন না । ওই সময় তার তৃষ্ণা পেয়েছিল । তখন দেবেন কারণ ওইটা যৌক্তিক।

যৌক্তিক কারণকে আমরা যদি দুরে সরিয়ে দেই তাহলে একসময় সে বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। সমাজবিরোধী কাজ করতে পারে। মাদকের মতো ভয়ংকর নেশা সে করতে পারে।

প্যারেন্টিং স্টাইল কেমন হবে। এর উত্তরে মোহিত কামাল বলেন,প্যারেন্টিংয়ের কয়েকটা স্টাইল আছে। আরেকটা হলো প্রাকটিস। কর্তৃত্ববাদী প্যারেন্টিং হলো যেখানে কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলে না। যেমন কোন সন্তানকে বাবা বলছে আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি তুমি রেডি হও। সন্তানের আবেগটাকে গুরুত্ব দেয় না । এরাই সামাজিক অনুষ্ঠানে মিশতে পারে না, অন্যান্য গুণগুলো চাপা পড়ে যায়।

গণতান্ত্রিক প্যারেন্টিং সন্তানের আবেগ বা মতামতকে গুরুত্ব দেয়। যেমন কোন সন্তানকে বাবা বলছে আমরা কক্সবাজার বেড়াতে যেতে চাই তোমার মতামত জানাও, কী করা যায়, ইত্যাদি ।

প্যারেন্টিংয়ের সবচেয়ে ভালো স্টাইল হলো গণতান্ত্রিক প্যারেন্টিং। সন্তানের মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকে সামাজিকভাবে তাকে শক্তিশালী করে । জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান থাকা কালে একবার মাদকবিরোধী দিবসের পতি পাদ্য বিষয় ছিল: আমরা আমাদের সন্তানের সঙ্গে কথা বলি। সন্তানের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে বাবা মায়ের বন্ধন শক্তিশালী হয়।

সন্তানের সঙ্গে কথা বলার সময় সন্তানের বয়সের,বোধের লেভেল এক হতে হবে। যখন আমরা কথা বলব সন্তানের কথায় মনোযোগ দিব। তার কথায় ফিডব্যাক দিব। সন্তানরা এটা চায়, তারা বুঝবে আমার কথা আমার বাবা বা মা শুনেছে । গুরুত্ব দিয়েছে। মাকে কথাটা বলতে পেরেছি। যদি শিশুর কথা না শুনেন, সে গাল ফুলিয়ে থাকবে। সন্তান ভালো কিছু করলে উল্লাস করবেন, জড়িয়ে ধরবেন। আদর করবেন। যোগ্যতা তৈরি হয় তার পারফরমেন্সের ওপর। নিজের ঘাটতি থাকলেও তা আবিষ্কার করতে হবে । সে বুদ্ধিমান নিজের ঘাটতি থেকে সংশোধন করতে পারে। তখন বাচ্চা বুঝতে পারে এটা আমার দোষ । শিশুর বেড়ে ওঠার ফাউন্ডেশন হলো প্যারেন্টিং।

শিশুকালে ভালো প্যারেন্টিং করা হলে ‘না ’ বলার সক্ষমতা তৈরি হবে। বন্ধুরা নেশার জন্য জোর করলেও সে ‘না’ বলতে পারবে। সবশেষে বলব বাবা-মা হাসিখুশি থাকবেন, ভালো দাম্পত্য সম্পর্ক থাকতে হবে। যদি স্বামী স্ত্রীর খোঁজ খবর নেয়। সন্তান দেখবে তার বাবা মা শান্তিতে আছে। সন্তান আত্মপ্রত্যয়ী হবে। মাদককে ‘না’ বলতে পারবে।