আলোর পাঠশালার মুক্তির আলো ছড়িয়ে পড়ুক দেশময়

আলোর পাঠশালার প্রাক্তন শিক্ষার্থী মাহফুজা খাতুন মুক্তি।
মুক্তি এখন পড়ছে রাজশাহীর শাহ মখদুম কলেজে।

রাজশাহীর পবা উপজেলার দুর্গম গ্রাম, নাম চরখিদিরপুর। এই গ্রামের তিন দিকেই ভারতীয় সীমানা আর এক দিকে পদ্মা নদী। শতভাগ বাল্যবিবাহের গ্রাম ছিল এই চরখিদিরপুর। সব মিলিয়ে ৬০০ পরিবারের বাস এই গ্রামে। এই গ্রামের লোকেরা জানতেনই না যে পঞ্চম শ্রেণির পর পড়া যায়। কখনো জানার দরকারও পড়েনি। পঞ্চম শ্রেণির পর ছেলেরা হতো রাখাল আর মেয়েদের তো তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। এই গ্রামের চেহারা পাল্টে ফেলেছিলেন রেজিনা খাতুন, নাসরিন খাতুন, রিপন আলী, মাসুম রনি, মিঠুন আলো সর্দারদের মতো মানুষেরা। রাজশাহী থেকে চরখিদিরপুর যাওয়ার একমাত্র পথ ছিল ট্রলার। সব মিলিয়ে ঘণ্টাখানেকের পথ। প্রতিদিন লাইফ জ্যাকেট পরে তাঁরা রাজশাহী থেকে চরখিদিরপুরের পথে জীবন হাতে নিয়ে যেতেন প্রথম আলো ট্রাস্টের আলোর পাঠশালায়। ঝড়, বৃষ্টি, কুয়াশা—কোনো কিছুই তাঁদের আটকে রাখতে পারত না। তাঁরা এই প্রত্যন্ত এলাকার ছেলেমেয়েদের পড়াতে যেতেন।

এই প্রত্যন্ত এলাকার আলোর পাঠশালারই শিক্ষার্থী মাহফুজা খাতুন মুক্তি। মুক্তি জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পাওয়ার পর এই গ্রামের মানুষ বুঝতে পারলেন, পঞ্চম শ্রেণির পরও জীবন আছে। শতভাগ বাল্যবিবাহের গ্রাম, যেখানে মেয়েদের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিয়ে না দেওয়াটাই একধরনের অপরাধ, সেই গ্রামের মেয়ে মুক্তি এখন পড়ছে রাজশাহীর শাহ মখদুম কলেজে। জীবনে কী হতে চাও জানতে চাইলে মুক্তি জানায়, সে যত দূর সম্ভব পড়াশোনা করে যেতে চায় এবং জীবনে আলোর পাঠশালার শিক্ষকদের মতো শিক্ষক হতে চায়। কেন আলোর পাঠশালার শিক্ষকদের মতো, আগ্রহ হলো জানতে। উত্তরে মুক্তি বলেন, ‘আমাদের গ্রামের মেয়েদের তো বিয়ে হয়ে যেত ছোটবেলায়। এই স্যার-ম্যাডামরা না থাকলে আমাদের জীবন আজ এমন হতো না। একবার আমাদের নদীভাঙনে আলোর পাঠশালার স্কুলঘরটি ভেঙে গেল। তখন তো আমাদের পড়ানোর কোনো জায়গা নেই। সেই সময়েও স্যার-ম্যাডামরা রাজশাহী থেকে এসেছেন। নদীর পাড়ে শীতের ঠান্ডা বাতাসের মধ্যেও আমাদের পড়িয়েছেন। আমরা সব সময় কৃতজ্ঞ থাকব আলোর পাঠশালার শিক্ষকদের কাছে।’

চরখিদিরপুর গ্রামটি নদীভাঙনের মুখে এখন আর নেই। ৬০০ পরিবারের গ্রামটিতে এখন গোটা দশেক পরিবার থাকে। বেশির ভাগ পরিবার চলে এসেছে রাজশাহী শহরের তালাইমারিতে। সেই সঙ্গে আলোর পাঠশালাও স্থানান্তর হয়েছে এখানে। আলোর পাঠশালার মুক্তিরা এখন আলো ছড়াচ্ছে। মুক্তিদের এই আলো ছড়িয়ে পড়ুক দেশময়। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি এ রকম অবহেলিত কয়েকটি এলাকায় শিক্ষার আলো পৌঁছে দিচ্ছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। অবহেলিত এসব এলাকার শিশুরা শিক্ষার পরিবর্তে অল্প বয়সেই বিভিন্ন কায়িক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ত। এর পেছনে অসচেতনতার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব ছিল একটা বড় কারণ। সামিট গ্রুপের আর্থিক সহযোগিতায় প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় এসব দুর্গম এলাকায় শিক্ষার আলো পৌঁছে যাচ্ছে। আলোকিত হচ্ছে পিছিয়ে পড়া মানুষ। বর্তমানে কুড়িগ্রামে ১টি, রাজশাহীতে ২টি, ভোলায় ১টি, নওগাঁয় ১টি, কক্সবাজারে ১টি করে মোট ৬টি স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। স্কুলগুলোতে বর্তমানে ১ হাজার ২০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।

লেখক: সমন্বয়ক, প্রথম আলো ট্রাষ্ট।