‘চরের অন্ধকার থেকে আলোতে এসেছি আমি’

আলোর পাঠশালার সাবেক শিক্ষার্থী মাহফুজা খাতুন মুক্তি

এইতো কয়েক দিন আগের কথা। ভোর হলেই দেখা যেত জেলেরা নদী থেকে মাছ ধরে বাড়ি ফিরছে, মাঝি ভাটিয়ালি গান গাইতে গাইতে খেয়া নৌকার বৈঠা বইছে, রাখাল মাঠে গরু নিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কেউবা হাসুয়া হাতে ঘাস কাটতে যাচ্ছে। আবার কেউবা লাঙল-গরু নিয়ে মাঠে যাচ্ছে হাল চাষ করতে।এসব অনুসঙ্গ নিয়ে গ্রামীণ প্রকৃতিতে ভরপুর ছিল রাজশাহীর পবা উপজেলার চরখিদিরপুর গ্রাম। এখন এগুলো সবই ইতিহাস। নদী গিলে খেয়েছে শত-শত পরিবার। এখনো চিহ্ন স্বরূপ কয়েকটি পরিবার চরেই বাস করছে। হয়তো দু-এক বছরের মধ্যে সেগুলোও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলার সীমানা পেরিয়ে আবার ভারতের মধ্যে প্রবেশ করবে সর্বনাশা পদ্মা।

আমি চরের অন্ধকার থেকে আলোতে এসেছি নানা রকমের বাধা পেরিয়ে। আমি চাই চরসহ দেশের কোনো মানুষ যেন নিরক্ষর না থাকে।

২০০৫ সালের দিকেও চরের মানুষেরা জানত না প্রাথমিক বিদ্যালয় পাসের পর দেশে লেখাপড়া হয়। তাইতো, প্রাথমিক পাস বা অধ্যয়নরত অবস্থায় চরের মেয়েদের বিয়ে হতো। ছেলেরা গরুর পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে কখন যে রাখাল হয়ে যেতো বুঝতেই পারত না। ২০১৫ সালে প্রথম আলো ট্রাস্ট পরিচালিত ‘চরখিদিরপুর আলোর পাঠশালা’ স্থাপনের পর চরের মানুষ মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ পায়। শতভাগ বাল্যবিয়ের গ্রামে দূর হতে থাকে বাল্যবিয়ে ও নিরক্ষরতার হার।

২০১৬ সালে চর থেকে প্রথম জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেন মাহফুজা খাতুন মুক্তি। ২০১৯ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৪.৬১ এবং ২০২১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায় মুক্তি। বর্তমানে তিনি রাজশাহী কলেজে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। মুক্তি বলেন, ‘প্রথম আলো ট্রাস্ট না থাকলে হয়তো অন্ধকারেই থাকত। আলোর পাঠশালা আমাকে আলো দেখিয়েছে। চির কৃতজ্ঞ এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি।’

শিক্ষকদের সঙ্গে মুক্তি।

বর্তমানে মুক্তির বাবা অসুস্থ। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। টানাপোড়নে চলছে তাদের সংসার। মুক্তির লেখাপড়ার খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে তার মা বলেন, ‘আমি আর প্যারব নাকো বাবা, কত বার বুলনু যে বিহ্যা কর-বিহ্যা কর ক্যরল না। এখন কিভাবে শহরের ইসকুলে (কলেজে) পড়াব? তোমরা দেখ্যা শুইনা একটা বিহ্যা দিয়া দ্যেও।’

কিন্তু মুক্তি চেষ্টায় আছেন নিজের মুক্তির জন্য। বিয়ের ব্যাপারে কোনো চিন্তা করছেন না তিনি। তাঁর জীবনের লক্ষ্য তিনি শিক্ষকতা করবেন। অনেক বড় হবেন। শিক্ষকতা পেশা কেনো করবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি চরের অন্ধকার থেকে আলোতে এসেছি নানা রকমের বাধা পেরিয়ে। আমি চাই চরসহ দেশের কোনো মানুষ যেন নিরক্ষর না থাকে। আমি শিক্ষক হলে দেশকে নিরক্ষরতা থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত করতে পাবর।’